আবদুল্লাহ আল মারুফ
পাঁচ বছর আগেও কুমিল্লা নগরের চকবাজার কামারপট্টিতে তৈরি জিনিসপত্রের কদর ছিল দেশজুড়ে। প্রতিবারই কোরবানি ঈদের প্রাক্কালে কামারপট্টিতে দাঁড়ানোর জায়গা মিলত না। এখন সেখানকার কামাররা সময় পার করছেন চা খেয়ে, আড্ডা দিয়ে! নেই ক্রেতার ভিড়। যারা আছেন তারাও পুরোনো ক্রেতা। তাই অভাব অনটনে পেশা হারানোর শঙ্কায় কুমিল্লার চকবাজারের কামারপট্টির কামাররা। বর্তমানে ৩০টি দোকান এখনও বংশ পরম্পরায় ধরে রেখেছে এই শিল্পের বৈঠা।
৩ পুরুষ এক দোকানে
শৈশবে বাবা মধুসূদন কর্মকারের সঙ্গে ঢোকেন দা, বঁটি আর ছুরির দোকানে। বাবা এখন গত হয়েছেন। কিন্তু বাবুল কর্মকার এখনও আছেন। বাবা-দাদাদের পেশার কথা মনে করে আপ্লুত হয়ে যান তিনি। বলেন, দাদা কামারগিরি করে বাবার জন্য সম্পদ জুড়িয়েছেন। সেটা বাবা ভোগ করে নিজেও জমিয়েছেন টাকাকড়ি। কিনেছেন সম্পত্তি। এখন দা, ছুরি, চাপাতি, কুড়াল বানানোর সোনালী সময় নেই। ভাত খাওয়া দায় হয়ে গেছে। আর ছেলে সন্তানের জন্য রাখব কি করে, এখন দেখি শুধু খরা আর খরা।
তিনি বলেন, প্রথম দিকে চকবাজারের কেন্দ্রস্থলেই ছিল কামারপট্টি। তখন হাতেগোনা কয়েকটি দোকান ছিল। পরে কিছু বাড়লে পট্টিটাকে আমির দিঘির পাশে নিয়ে আসা হয়। কয়েক বছর আগেও ছুরি-বঁটি কেনা, বানানো ও ধার দেওয়ার জন্য মানুষ লাইনে দাঁড়াত। সকালে অর্ডার দিয়ে গেলে নিতে হতো পরদিন। একেক দোকানে কারিগর থাকতো ৮-১০ জন। কোরবানির ঈদ এলে দিন-রাত কাজ করেও কূল পেতেন না কামাররা।
‘বউ বাচ্চা নিয়ে ভালোই চলেছিল একসময়। ছোটবেলায় দেখেছি বাবার সঙ্গের কারিগর ও দোকান মালিক অনেকের ঘরবাড়িও পাকা হয়েছে এ কাজ করে। ঘরে সব সময় ভালো খাবার ছিল। এখন আর সেদিন নেই। পেশাটাই যেন শত্রু হয়ে দাঁড়িয়েছে। দা, ছুরিই যেন আমাদের আয়-রোজগার কেটে নিয়ে গেছে।’
কয়েক দোকান পরে মন খারাপ করে বসে থাকতে দেখা যায় মো. সিরাজ নামের এক দোকানিকে। কথা বললে তিনি জানান, তার বাবাও একই ভিটিতে দোকানদারি করেছেন। দাদাও ছিলেন কর্মকার। খুশির সময় কেটেছে বাবার আমলে। মো. সিরাজ বলেন, লোহার দাম বেশি। প্রতিটা জিনিসের দাম বাড়াতে হয়েছে। যে কারণে অনেকে স্টিলের জিনিসে ঝুঁকছেন। এখন দা-এর দাম সাইজ অনুযায়ী ৪০০ থেকে ৮০০ টাকা। আগে যা ছিল ২০০ থেকে ৬০০ টাকার মধ্যে। চাপাতির দাম এখন সাইজ বুঝে ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা। বঁটি দা ২৫০ থেকে ৮০০ টাকা। ছুরি ছোট-বড় ৫০ থেকে ২৫০ টাকা। আবার পশু জবাইয়ের বড় ছুরি ৫০০ থেকে ৮০০ বা তার কমবেশি টাকায় বিক্রি করি। যা গত কয়েক বছর আগের চেয়ে ১০০ টাকা বেশি।
কামারপট্টিতে ভিড় নেই যে কারণে
প্রবীণ কর্মকার হানিফ মিয়া বললেন, কামারপট্টি আগে জমজমাট ছিল। সারা বছর কাজ থাকত। ঈদে রোজগারও ভালো হতো। এখন বিভিন্ন কোম্পানি স্টিলের জিনিস বাজারে এনেছে। সেগুলোর দাম আমাদের শ্রমের তুলনায় কম। সেগুলো রেডিমেড পাওয়া যায়। তাই মানুষ এখন আর আমাদের কাছে আসে না।
এখন আবার আধুনিক মেশিন দিয়ে বাড়ি বাড়ি গিয়ে দা, ছুরি ধার দিয়ে আসে কিছু লোক। তাই একবার কিছু কিনলে আর আমাদের কাছে আসতে হয় না। এছাড়া ভাঙা জাহাজের লোহার দাম বেড়েছে। যে কারণে অনেক ব্যবসায়ী পুঁজির অভাবে এই কাজ ছেড়ে দিচ্ছেন। কয়লার দামও দিগুণ। আগে ছিল সাত কেজি ৪০ টাকা, এখন ৭০ টাকা। আমাদের কাজ অনুযায়ী দিনে প্রায় ১৫ থেকে ২০ কেজি কয়লা লাগে। খোঁজ নিয়ে আরও জানা গেলো, আগে কারিগরের বেতন ছিল দিনে ৩০০ টাকা। এখন তা বেড়ে ৮০০ টাকা হয়েছে।
যেভাবে টিকিয়ে রাখা যাবে
তিন পুরুষ কামার পেশায় জড়িত থাকা মো. সিরাজ কর্মকার বলেন, এখনও এই শিল্পকে টিকিয়ে রাখা সম্ভব। সরকার কত পদক্ষেপ নেয়। আমাদের জন্য কেউ কিছু করল না। আমাদের পেটে ভাত ওঠে না। আমাদের বিনা সুদে ঋণ দিলে ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে পারতাম। শত বছরের একটা শিল্পও টিকে থাকত।
এ সময় তিনি বলেন, বিদেশি জিনিস ঢুকছে। যে কারণে এ ঐতিহ্য হুমকির মুখে। সরকার যদি এসব পণ্য বন্ধ করে দেয় তাহলে এই শিল্প ও এই শিল্পের সাথে জড়িতদের টিকিয়ে রাখা সম্ভব।
বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক) কুমিল্লার উপমহাব্যবস্থাপক মো. মুনতাসীর মামুন বলেন, এটি দেশের প্রাচীন একটি শিল্প। কর্মকারদের এই শিল্পটি কেন পিছিয়ে পড়ছে? কোন কোন সমস্যার মুখোমুখি তারা হচ্ছেন এসব বিষয় যদি আমাদরে জানান তাহলে আমরা ব্যবস্থা নিতে পারতাম। সরকারি সুযোগ-সুবিধাতে তাঁরা অভ্যস্থ নয়। আমরা চাই তাঁরা সমস্যার কথা জানাক। তাহলে আমরা কাজ করতে সুবিধা। তাছাড়া যদি কোন ঋণ সহযোগিতা দরকার হয়, তাহলেও আমরা ব্যবস্থা করে দিতে পারব।
পাঁচ বছর আগেও কুমিল্লা নগরের চকবাজার কামারপট্টিতে তৈরি জিনিসপত্রের কদর ছিল দেশজুড়ে। প্রতিবারই কোরবানি ঈদের প্রাক্কালে কামারপট্টিতে দাঁড়ানোর জায়গা মিলত না। এখন সেখানকার কামাররা সময় পার করছেন চা খেয়ে, আড্ডা দিয়ে! নেই ক্রেতার ভিড়। যারা আছেন তারাও পুরোনো ক্রেতা। তাই অভাব অনটনে পেশা হারানোর শঙ্কায় কুমিল্লার চকবাজারের কামারপট্টির কামাররা। বর্তমানে ৩০টি দোকান এখনও বংশ পরম্পরায় ধরে রেখেছে এই শিল্পের বৈঠা।
৩ পুরুষ এক দোকানে
শৈশবে বাবা মধুসূদন কর্মকারের সঙ্গে ঢোকেন দা, বঁটি আর ছুরির দোকানে। বাবা এখন গত হয়েছেন। কিন্তু বাবুল কর্মকার এখনও আছেন। বাবা-দাদাদের পেশার কথা মনে করে আপ্লুত হয়ে যান তিনি। বলেন, দাদা কামারগিরি করে বাবার জন্য সম্পদ জুড়িয়েছেন। সেটা বাবা ভোগ করে নিজেও জমিয়েছেন টাকাকড়ি। কিনেছেন সম্পত্তি। এখন দা, ছুরি, চাপাতি, কুড়াল বানানোর সোনালী সময় নেই। ভাত খাওয়া দায় হয়ে গেছে। আর ছেলে সন্তানের জন্য রাখব কি করে, এখন দেখি শুধু খরা আর খরা।
তিনি বলেন, প্রথম দিকে চকবাজারের কেন্দ্রস্থলেই ছিল কামারপট্টি। তখন হাতেগোনা কয়েকটি দোকান ছিল। পরে কিছু বাড়লে পট্টিটাকে আমির দিঘির পাশে নিয়ে আসা হয়। কয়েক বছর আগেও ছুরি-বঁটি কেনা, বানানো ও ধার দেওয়ার জন্য মানুষ লাইনে দাঁড়াত। সকালে অর্ডার দিয়ে গেলে নিতে হতো পরদিন। একেক দোকানে কারিগর থাকতো ৮-১০ জন। কোরবানির ঈদ এলে দিন-রাত কাজ করেও কূল পেতেন না কামাররা।
‘বউ বাচ্চা নিয়ে ভালোই চলেছিল একসময়। ছোটবেলায় দেখেছি বাবার সঙ্গের কারিগর ও দোকান মালিক অনেকের ঘরবাড়িও পাকা হয়েছে এ কাজ করে। ঘরে সব সময় ভালো খাবার ছিল। এখন আর সেদিন নেই। পেশাটাই যেন শত্রু হয়ে দাঁড়িয়েছে। দা, ছুরিই যেন আমাদের আয়-রোজগার কেটে নিয়ে গেছে।’
কয়েক দোকান পরে মন খারাপ করে বসে থাকতে দেখা যায় মো. সিরাজ নামের এক দোকানিকে। কথা বললে তিনি জানান, তার বাবাও একই ভিটিতে দোকানদারি করেছেন। দাদাও ছিলেন কর্মকার। খুশির সময় কেটেছে বাবার আমলে। মো. সিরাজ বলেন, লোহার দাম বেশি। প্রতিটা জিনিসের দাম বাড়াতে হয়েছে। যে কারণে অনেকে স্টিলের জিনিসে ঝুঁকছেন। এখন দা-এর দাম সাইজ অনুযায়ী ৪০০ থেকে ৮০০ টাকা। আগে যা ছিল ২০০ থেকে ৬০০ টাকার মধ্যে। চাপাতির দাম এখন সাইজ বুঝে ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা। বঁটি দা ২৫০ থেকে ৮০০ টাকা। ছুরি ছোট-বড় ৫০ থেকে ২৫০ টাকা। আবার পশু জবাইয়ের বড় ছুরি ৫০০ থেকে ৮০০ বা তার কমবেশি টাকায় বিক্রি করি। যা গত কয়েক বছর আগের চেয়ে ১০০ টাকা বেশি।
কামারপট্টিতে ভিড় নেই যে কারণে
প্রবীণ কর্মকার হানিফ মিয়া বললেন, কামারপট্টি আগে জমজমাট ছিল। সারা বছর কাজ থাকত। ঈদে রোজগারও ভালো হতো। এখন বিভিন্ন কোম্পানি স্টিলের জিনিস বাজারে এনেছে। সেগুলোর দাম আমাদের শ্রমের তুলনায় কম। সেগুলো রেডিমেড পাওয়া যায়। তাই মানুষ এখন আর আমাদের কাছে আসে না।
এখন আবার আধুনিক মেশিন দিয়ে বাড়ি বাড়ি গিয়ে দা, ছুরি ধার দিয়ে আসে কিছু লোক। তাই একবার কিছু কিনলে আর আমাদের কাছে আসতে হয় না। এছাড়া ভাঙা জাহাজের লোহার দাম বেড়েছে। যে কারণে অনেক ব্যবসায়ী পুঁজির অভাবে এই কাজ ছেড়ে দিচ্ছেন। কয়লার দামও দিগুণ। আগে ছিল সাত কেজি ৪০ টাকা, এখন ৭০ টাকা। আমাদের কাজ অনুযায়ী দিনে প্রায় ১৫ থেকে ২০ কেজি কয়লা লাগে। খোঁজ নিয়ে আরও জানা গেলো, আগে কারিগরের বেতন ছিল দিনে ৩০০ টাকা। এখন তা বেড়ে ৮০০ টাকা হয়েছে।
যেভাবে টিকিয়ে রাখা যাবে
তিন পুরুষ কামার পেশায় জড়িত থাকা মো. সিরাজ কর্মকার বলেন, এখনও এই শিল্পকে টিকিয়ে রাখা সম্ভব। সরকার কত পদক্ষেপ নেয়। আমাদের জন্য কেউ কিছু করল না। আমাদের পেটে ভাত ওঠে না। আমাদের বিনা সুদে ঋণ দিলে ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে পারতাম। শত বছরের একটা শিল্পও টিকে থাকত।
এ সময় তিনি বলেন, বিদেশি জিনিস ঢুকছে। যে কারণে এ ঐতিহ্য হুমকির মুখে। সরকার যদি এসব পণ্য বন্ধ করে দেয় তাহলে এই শিল্প ও এই শিল্পের সাথে জড়িতদের টিকিয়ে রাখা সম্ভব।
বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক) কুমিল্লার উপমহাব্যবস্থাপক মো. মুনতাসীর মামুন বলেন, এটি দেশের প্রাচীন একটি শিল্প। কর্মকারদের এই শিল্পটি কেন পিছিয়ে পড়ছে? কোন কোন সমস্যার মুখোমুখি তারা হচ্ছেন এসব বিষয় যদি আমাদরে জানান তাহলে আমরা ব্যবস্থা নিতে পারতাম। সরকারি সুযোগ-সুবিধাতে তাঁরা অভ্যস্থ নয়। আমরা চাই তাঁরা সমস্যার কথা জানাক। তাহলে আমরা কাজ করতে সুবিধা। তাছাড়া যদি কোন ঋণ সহযোগিতা দরকার হয়, তাহলেও আমরা ব্যবস্থা করে দিতে পারব।