মোহাম্মদ শাহনুর আলম
বরুড়ার খোশবাস (দ:)ইউনিয়নের রাজামারা গ্রামে আমার জন্ম ও বেড়ে উঠা। ৮০'র দশক জুড়ে ছিলো স্কুল জীবন।ছোড ওয়ানে পড়াকালিন পাড়ায় একদল বন্ধু ছিলো। এরা সকালে মক্তবে গেলেও স্কুলে ঠিকঠাক যেতনা। আমরা সারাদিন পই পই করে একসাথে ঘুরতাম, খেলতাম। গাব, কাউ, ছাগললাদি, তেতুল, জাম এসব পেড়ে খেতাম।জামগাছের মগডালে বাতাসের দুলুনিতে পুবের লালমাই পাহাড় দেখা যেত।তালের ডাব, খেজুর রস বা লিচু চুরি ছিল ছোট বেলার এডভেঞ্চার।বড়রা ডাবা খেত, কৌতূহলবশত চুপিসারে দু একটা টান দিয়েছিলাম-ভালো লাগেনি। দলবেঁধে পুকুরে ডুবিয়ে গোসল করতাম। ভাত খেতে দুপুরে লাল চোখে বাড়িতে গেলেই ধরা আর মায়ের বকুনি। বিকেল হলেই খেলার ডাক-কখনো উঠোনে, কখনো স্কুল মাঠে কখনোবা নাড়াখেতে। কাবাডি, দাড়িয়াবান্ধা, বউচি, গোল্লাছুট, সাততারা, টেম ডাং। ভাইয়ের সাথে খেলেছি ফুটবল , ক্রিকেট। লাটিম, মার্বেলের পাশাপাশি সীমের বিচির পন দিয়ে দাগগী খেলতাম। কুতকুত , বাঘবন্দি , খেজুর বীচি দিয়ে দশঘইররা খেলেছি। সুপারির বাইলে বসিয়ে বন্ধুকে টেনে নিয়ে পাড়া ঘুরানোর ট্রেড মার্ক স্মৃতি সত্যিই অমুল্য। হাড়ির ভাংগা টুকরা দিয়ে পুকুরের পানিতে ব্যাংচাই খেলা আর বর্ষায় ভরা পুকুরে কদমফুলের ডুবি ডুবি ভেসে চলা খুবই মনে পড়ে। টিনের চালে বৃষ্টির ছন্দ, ঘনকালো কালবৈশাখীর দাপটে আমকুড়ানো,উঠোনে শিলা বৃষ্টির খইফোটা দৃশ্য বা কলাগাছের ভেলায় শুয়ে মাঝপুকুরে আকাশ দেখার স্মৃতি সত্যিই অমলিন।পুকুরপাড়ে দলবেঁধে পিড়ায় বসে জাক দেয়া পাটগাছের আশ ছাড়িয়েছি। শুকোতে দেয়া হরমোলার ত্রিকোণ পিরামিডে লুকোচুরি খেলেছি।অজস্র কচুরিপানা ফুলের ছবি তুলে রাখা তখন সহজ ছিলোনা। খুবই কঠিন ছিলো নাপিতের হাটুর চিপায় গুজে দিয়ে মাথা কামানোর বাজে অভিজ্ঞতা। কৃষনচুড়ার ডালা ছিড়িবার লাল স্মৃতি খুব মনে পড়ে। শাপলা ফুলের লতায় জড়িয়ে বাড়ি ফিরেছি দুপুর পেরিয়ে। শরতে কাশ ফুল আনতে যেয়ে ঝোপে কুড়িয়ে পেয়েছি হাসের ডিম। আশায় আশায় আবারও গিয়েছি, আর পাইনি।ছোট বেলায় গম খেতে ভোরে শালিক তাড়াতে হতো। এই ফুরসতে ছোটরা মিলে জমির কোনেই খেলা হতো মধুর স্মৃতির জোলাবাত্তি।
শৈশবে বাবার হুমকি এড়িয়ে বন্ধুদের দেয়া চ্যালেঞ্জ জিতেছি; পুলের উচু থেকে খালের পানিতে লাফিয়ে পড়েছি। আজ তা সম্ভব না হলেও এখনো মন চায় ছেড়ে দেই ঘাটের নৌকার বাধন; মাঝ দিঘিতে ছইয়ের তলায় বসে বন্ধুরা মিলে আবার খেলি ছোট বেলার ৩২ তাস। হারিয়ে গেছে গান গেয়ে গুন টেনে ধানের নৌকা নেয়ার দৃশ্য। ঢেকি ঘরে ধান বানার শব্দ, গরুর ঘরের এমোনিয়া স্মেল আর বাড়ির দূরকোনের বৈঠক খানার অলস সময় ঘুরে ফিরে আসে স্মৃতিতে।
মিশ্র ধান বা মরা ধানকে বলা হতো উড়কা যা কেটে এনে গাভী কে খাওয়াতাম। ক্ষেতের আল ধরে ধানের শীষে বাতাসের দোল খাওয়ার দৃশ্যে আজও একাকার অনুভব করি।ধান কাটা হলে খাড়ু পানিতে দলবেঁধে খাডালি দিতাম;জমির এক কোনে দাপিয়ে নিয়ে শিং, মাগুর, কই, টাকি, খইয়া, পুটি এসব মাছ ধরে ভাগ করে নিতাম। চাষের জমি প্রস্তুতে শৈশবে মই এর উপর বসেছি অনেকবার। আমাদের উঠোনে ধান মাড়াই হতো। বিছানো আটির ধান ঝরাতে মাঝ উঠোনে ৮-১০ টি গরু পাশাপাশি বেধে ঘুরানো হতো ; আউল্যাচিবা হাতে গরুর পিছনে ঘুরেছে কত শৈশব।খড় শুকিয়ে বাড়ির গাডায় মুরুইল দিতাম, এই মজুত খড়েই চলত গরুর খাওয়া আর ঘরের জ্বালানি। দলবেঁধে কাঠালের মুচই বা কলার থোর খেয়েছি।সীম গাছের ঝোপে ঘুঘুর বাচ্ছা পাহারা দিতাম। উড়তে পারার ঠিক আগে আগে ধরে এনে খাচায় পুসতাম, একটু বড় হলে মায়া লাগত, বাধন ছেড়ে উড়িয়ে দিতাম। আমাদের বাড়িতে কবুতর পোষা হত। উঠোনের বাতাসে ওদের ডিগবাজি আর ছনের চালায় বসে বাকবাকুম ডাকে বাংময় থাকত বাড়ি। শীতকালে আখ মাড়াই হলে ছোট বড় সবাই রাতজেগে নোনা খেতাম। জিব পোড়ার দু:সহ স্মৃতিও ভূলার নয়। ভীষণ লোভনীয় ছিল পাহালের আগুনে পোড়া আলুর স্বাদ! শীতকালে আমরা আগুন পোহাতাম।আমাদের পাড়ায় গরু খিলাইতে শীতের ভোরে প্রাগৈতিহাসিক আওয়াজ তুলে ঘোষ আসতো। বেদেদের দাত খিলিয়ে পোকা বের করার দৃশ্য মনে পরে। কাঊট্টা গুলো শীতের রোদ গায়ে মাখাতে পুকুরপাড়ে বসত আর পায়ে ধাপ দিলেই টুপ করে নেমে যেত পানিতে।
সব ঘরেই মায়েরা মুঠ চাল রাখত।উদবৃত্ত ডিম খাচায় জমাতো আর ডিমওয়ালা এসে কিনে নিত।আমরা পেয়াজ, শীমের বীচি, কুমড়া এসব শুকিয়ে সংরক্ষণ করতাম। বাশের পালায় ছিদ্র করে পয়সা জমাতাম। বাড়িতে মেহমান আসলে ঘরের চিপায় মাছের জাল টাংগিয়ে ধাওয়া করে মুরগী ধরতাম।আমার মা কুশিকাটার কাজ, বেতের কাজ, জাল বুনা, সেলাই কাজ এসব করতেন; আমি অবাক চোখে দেখতাম আর সাহায্য করতাম। মা চাচিরা অবসরে আগ পিছ বসে চুলে বেনী কাটত। কর্দমাক্ত রাস্তায় একবার জেঠার সাথে কাঠাল কিনতে বাতাইছড়ি বাজার গেচিলাম। কাদা পথে হাটার জন্য জেঠা খরম আর আমার জন্য নাগরা জুতা কিনেছিল। খাল বিলে তখন প্রচুর মাছ হতো। বড়রা জাল মারত আর ছোটরা ডুলা ধরত। বরুড়া বাজারে ইলিশ মাছ মাথায় নিয়ে বেচত, তখন অফ সিজনে টিনে ভরা নোনা ইলিশ পাওয়া যেত। বর্ষায় অতিবৃষ্টিতে মাছের জোয়া লাগলে আনতা পাততাম, চাই দিয়ে মাছ ধরতাম। শীতকালে দীঘিতে বোয়াল মাছ ধরতে বরশি পাততাম, ঘন কুয়াশায় দলবেঁধে মাছের আশায় রাত জাগতাম।অনেক সময় এতো মাছ হতো যে কুটে শেষ করা যেতনা,পচে যাবার ভয়ে শুটকি করতে হতো। তখন লবণের পোটলা আর সুতায় ঝুলানো বোতলে কেরাসিন নিয়ে বাজার থেকে বাড়ি ফিরত গ্রামের মানুষ। ঝোপের আড়ালে মল ত্যাগের অভ্যাস মানুষের এখন আর নেই। মনে পড়ে সেই সময় বরুড়া থেকে মুড়ির টিনে কুমিল্লা শহরে বেড়াতে গিয়েছিলাম।
আমরা কুপি-হারিকেনের আলোয় পড়তাম।সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলে ঘরে ফিরে পড়তে বসতাম। শব্দ করে পড়তে হতো। পড়া শেষে খেয়ে বোনের বিছুনের বাতাসে ঘুমাতাম।তখন মিটমিট আলো দিত বোতলে ভরা জোনাকির দল।তারাভরা আধার রাতে উঠোনের বিছানায় দাদির কাছে কল্পলোকের কিচ্ছা শুনতে শুনতে অজান্তেই ঘুম এসে যেত।আশপাশের গ্রামে কবিগান, যাত্রাপালা, ওয়াজ মাহফিল কিংবা পুড়ধরার আসর বসতো। নিশুতি রাতে সংগী নিয়ে চুপিসারে দেখে আসতাম।গ্রামের জোছনা অপার, জোনাকির ঝিকিমিকি অথবা অপেক্ষার বৃষ্টির পর শত ব্যাংগের কোলাহল আর শুনিনা, দেখিনা। ফসলের মাঠ ভেংগে কাসেড্ডায় স্কুলের পথে মটরশুঁটি ক্ষেতে লুটোপুটি আর তিল ফুলে মৌমাছি ধরতে যেয়ে হুল ফুটানোর স্মৃতিতো ভুলার নয়।প্রাইমারিতে বার্ষিক ক্রীড়ার স্মৃতিই সবচেয়ে মনে পড়ে। ব্রেক এ পাশের হিন্দু বাড়িতে বন্ধুরাসহ হাটতে যেয়ে ফলভর্তি গাছ দেখতাম, সুস্বাদু নারিকেলের নাড়ু খাবারও অভিজ্ঞতা হয়েছে। মহেশপুর স্কুলে বৃত্তির পড়ার জন্য রাতে দলবেঁধে হোষ্টেলে থাকতাম, পালাক্রমে স্যারের জন্য খাবার নিয়ে যাবার দায়িত্ব ছিলো সেই বয়সে।
ছোট বেলায় আমি পালকি চড়ে নাইওর যাবার হাক শুনেছি। প্রচন্ড খরায় দলবেঁধে বাড়ি বাড়ি গিয়ে বৃষ্টির গান গাইতে দেখেছি। নিজে শুনেছি সেহরির জন্য ঘুম ভাংগা দলের গান।
মনে পড়ে,শাহপুরের বৈশাখী মেলায় যেতাম। টেনটেনি কিনে এনে পাড়াজুড়ে ঘুরে ঘুরে বাজাতাম। ডাউস গুন্ডি কিনতাম প্রতি বছর , পরাণ ভরে উড়াতাম, ঘুড়ির পিছনে দৌড়িয়ে কেটে যেত সারাবেলা। একবার বড় একটা হানক গুন্ডি বানিয়েছিলাম , অগোচরে মায়ের পুরনো শাড়ী নিয়ে ঘুড়িটিতে লম্বা লেজ দিয়েছিলাম আর লাগিয়েছিলাম বড় বোয়া।স্বপ্নের সেই ঘুড়ি দূর আকাশে উড়িয়ে বাড়ি এনে খুটিতে বেধে রেখেছিলাম আর গ্রামজুড়ে মধুর সুর দিয়েছিল সেই ঘুড়ি রাতভর। অন্য অনেকের মতো সাইকেলের পরিত্যক্ত চাকা আমিও ঘুড়িয়েছি। স্টিক নিয়ে রিং এর পিছু দৌড়িয়ে কেটেছে আমারও দূরন্ত শৈশব।
আমার মামাবাড়ি গোহালিয়া। আদরের কমতি ছিলো না সেখানে । খেলতে যেয়ে আমি দোষ করলেও মামির বকাটা নিশ্চিতভাবেই খেত মামাত ভাই। ওর সাথে ফাদ পেতে দোয়েল পাখি ধরা আর বেল বেয়ে মাছ ধরার স্মৃতি এখনো তাজা।মামাবাড়ির নিকটেই নিমসার, কাবিলা। কান পাতলেই আসতো দূরগামী সব গাড়ির শব্দ আর কেমন যেন করতো আমার শিশুমন। কৈশোরে ৫ কিলোমিটার দুরের বরুড়া স্কুলে হেঁটে গিয়েছি ; অসম্ভব লাগেনি।
স্কুলে স্কাউটিং এর শিক্ষা গ্রামে কাজে লাগাতাম-রাস্তার গর্ত ভরাট , মসজিদের যত্ন, কচুরিপানা পরিস্কার,অন্ধকে পথ দেখানো এইসব করতাম। ক্লাসে প্রথম হলে, বৃত্তি পেলে বাহবা পেতাম। মা চাচিদের পা ছুয়ে সালাম করতাম। মহিলারা রিক্সায় বেডং দিয়ে চলত। গুরুজনদের দেখলে রাস্তায় সাইকেল থেকে নেমে যেতাম। বিয়েতে জামাই কে বাইসাইকেল উপহার দিত। স্বাধীনতা দিবসের কুচকাওয়াজ , শারীরিক কসরত এর কথা মনে পড়ে আর মনে পড়ে প্রভাত ফেরির অমর গান।
শৈশবে ঈদের ছুটিতে চুপিচুপি বন্ধুরা মিলে লাকসাম, চান্দিনা, ক্যান্টনমেন্ট , কুমিল্লা যেয়ে দলবেঁধে সিনেমা দেখতাম। হলের ভিতর উলুশের কামড় ব্ল্যাক এ যুদ্ধ করে টিকেট কাটার আনন্দ ম্লান করে দিত। আবার ফকিরা বাজারে গরুর লাথি খেয়েও ঈদের গরু নিয়ে বাড়ি ফেরার উতসাহে কোনো ঘাটতি হতোনা।কোরবানির গরুর ভূড়ি দিয়ে ঢোল বানিয়ে বাজাতাম।রমজান আসলে সমবয়সীদের রোজা রাখার প্রতিযোগিতা হতো। ঈদে বোন আর মামী দিত নতুন জুতা-জামা, এই দিয়েই চলে যেত বছর। রমজানের কাঊন্টডাউন শেষে সন্ধ্যায় দলবেঁধে হই হুল্লুর করে ঈদের চাদ দেখতাম - সেই এক ফালি বাকা চাদেই ফিরে ফিরে আসে আমাদের শ্বাসত ঈদ - ঈদ মোবারক!
বরুড়ার খোশবাস (দ:)ইউনিয়নের রাজামারা গ্রামে আমার জন্ম ও বেড়ে উঠা। ৮০'র দশক জুড়ে ছিলো স্কুল জীবন।ছোড ওয়ানে পড়াকালিন পাড়ায় একদল বন্ধু ছিলো। এরা সকালে মক্তবে গেলেও স্কুলে ঠিকঠাক যেতনা। আমরা সারাদিন পই পই করে একসাথে ঘুরতাম, খেলতাম। গাব, কাউ, ছাগললাদি, তেতুল, জাম এসব পেড়ে খেতাম।জামগাছের মগডালে বাতাসের দুলুনিতে পুবের লালমাই পাহাড় দেখা যেত।তালের ডাব, খেজুর রস বা লিচু চুরি ছিল ছোট বেলার এডভেঞ্চার।বড়রা ডাবা খেত, কৌতূহলবশত চুপিসারে দু একটা টান দিয়েছিলাম-ভালো লাগেনি। দলবেঁধে পুকুরে ডুবিয়ে গোসল করতাম। ভাত খেতে দুপুরে লাল চোখে বাড়িতে গেলেই ধরা আর মায়ের বকুনি। বিকেল হলেই খেলার ডাক-কখনো উঠোনে, কখনো স্কুল মাঠে কখনোবা নাড়াখেতে। কাবাডি, দাড়িয়াবান্ধা, বউচি, গোল্লাছুট, সাততারা, টেম ডাং। ভাইয়ের সাথে খেলেছি ফুটবল , ক্রিকেট। লাটিম, মার্বেলের পাশাপাশি সীমের বিচির পন দিয়ে দাগগী খেলতাম। কুতকুত , বাঘবন্দি , খেজুর বীচি দিয়ে দশঘইররা খেলেছি। সুপারির বাইলে বসিয়ে বন্ধুকে টেনে নিয়ে পাড়া ঘুরানোর ট্রেড মার্ক স্মৃতি সত্যিই অমুল্য। হাড়ির ভাংগা টুকরা দিয়ে পুকুরের পানিতে ব্যাংচাই খেলা আর বর্ষায় ভরা পুকুরে কদমফুলের ডুবি ডুবি ভেসে চলা খুবই মনে পড়ে। টিনের চালে বৃষ্টির ছন্দ, ঘনকালো কালবৈশাখীর দাপটে আমকুড়ানো,উঠোনে শিলা বৃষ্টির খইফোটা দৃশ্য বা কলাগাছের ভেলায় শুয়ে মাঝপুকুরে আকাশ দেখার স্মৃতি সত্যিই অমলিন।পুকুরপাড়ে দলবেঁধে পিড়ায় বসে জাক দেয়া পাটগাছের আশ ছাড়িয়েছি। শুকোতে দেয়া হরমোলার ত্রিকোণ পিরামিডে লুকোচুরি খেলেছি।অজস্র কচুরিপানা ফুলের ছবি তুলে রাখা তখন সহজ ছিলোনা। খুবই কঠিন ছিলো নাপিতের হাটুর চিপায় গুজে দিয়ে মাথা কামানোর বাজে অভিজ্ঞতা। কৃষনচুড়ার ডালা ছিড়িবার লাল স্মৃতি খুব মনে পড়ে। শাপলা ফুলের লতায় জড়িয়ে বাড়ি ফিরেছি দুপুর পেরিয়ে। শরতে কাশ ফুল আনতে যেয়ে ঝোপে কুড়িয়ে পেয়েছি হাসের ডিম। আশায় আশায় আবারও গিয়েছি, আর পাইনি।ছোট বেলায় গম খেতে ভোরে শালিক তাড়াতে হতো। এই ফুরসতে ছোটরা মিলে জমির কোনেই খেলা হতো মধুর স্মৃতির জোলাবাত্তি।
শৈশবে বাবার হুমকি এড়িয়ে বন্ধুদের দেয়া চ্যালেঞ্জ জিতেছি; পুলের উচু থেকে খালের পানিতে লাফিয়ে পড়েছি। আজ তা সম্ভব না হলেও এখনো মন চায় ছেড়ে দেই ঘাটের নৌকার বাধন; মাঝ দিঘিতে ছইয়ের তলায় বসে বন্ধুরা মিলে আবার খেলি ছোট বেলার ৩২ তাস। হারিয়ে গেছে গান গেয়ে গুন টেনে ধানের নৌকা নেয়ার দৃশ্য। ঢেকি ঘরে ধান বানার শব্দ, গরুর ঘরের এমোনিয়া স্মেল আর বাড়ির দূরকোনের বৈঠক খানার অলস সময় ঘুরে ফিরে আসে স্মৃতিতে।
মিশ্র ধান বা মরা ধানকে বলা হতো উড়কা যা কেটে এনে গাভী কে খাওয়াতাম। ক্ষেতের আল ধরে ধানের শীষে বাতাসের দোল খাওয়ার দৃশ্যে আজও একাকার অনুভব করি।ধান কাটা হলে খাড়ু পানিতে দলবেঁধে খাডালি দিতাম;জমির এক কোনে দাপিয়ে নিয়ে শিং, মাগুর, কই, টাকি, খইয়া, পুটি এসব মাছ ধরে ভাগ করে নিতাম। চাষের জমি প্রস্তুতে শৈশবে মই এর উপর বসেছি অনেকবার। আমাদের উঠোনে ধান মাড়াই হতো। বিছানো আটির ধান ঝরাতে মাঝ উঠোনে ৮-১০ টি গরু পাশাপাশি বেধে ঘুরানো হতো ; আউল্যাচিবা হাতে গরুর পিছনে ঘুরেছে কত শৈশব।খড় শুকিয়ে বাড়ির গাডায় মুরুইল দিতাম, এই মজুত খড়েই চলত গরুর খাওয়া আর ঘরের জ্বালানি। দলবেঁধে কাঠালের মুচই বা কলার থোর খেয়েছি।সীম গাছের ঝোপে ঘুঘুর বাচ্ছা পাহারা দিতাম। উড়তে পারার ঠিক আগে আগে ধরে এনে খাচায় পুসতাম, একটু বড় হলে মায়া লাগত, বাধন ছেড়ে উড়িয়ে দিতাম। আমাদের বাড়িতে কবুতর পোষা হত। উঠোনের বাতাসে ওদের ডিগবাজি আর ছনের চালায় বসে বাকবাকুম ডাকে বাংময় থাকত বাড়ি। শীতকালে আখ মাড়াই হলে ছোট বড় সবাই রাতজেগে নোনা খেতাম। জিব পোড়ার দু:সহ স্মৃতিও ভূলার নয়। ভীষণ লোভনীয় ছিল পাহালের আগুনে পোড়া আলুর স্বাদ! শীতকালে আমরা আগুন পোহাতাম।আমাদের পাড়ায় গরু খিলাইতে শীতের ভোরে প্রাগৈতিহাসিক আওয়াজ তুলে ঘোষ আসতো। বেদেদের দাত খিলিয়ে পোকা বের করার দৃশ্য মনে পরে। কাঊট্টা গুলো শীতের রোদ গায়ে মাখাতে পুকুরপাড়ে বসত আর পায়ে ধাপ দিলেই টুপ করে নেমে যেত পানিতে।
সব ঘরেই মায়েরা মুঠ চাল রাখত।উদবৃত্ত ডিম খাচায় জমাতো আর ডিমওয়ালা এসে কিনে নিত।আমরা পেয়াজ, শীমের বীচি, কুমড়া এসব শুকিয়ে সংরক্ষণ করতাম। বাশের পালায় ছিদ্র করে পয়সা জমাতাম। বাড়িতে মেহমান আসলে ঘরের চিপায় মাছের জাল টাংগিয়ে ধাওয়া করে মুরগী ধরতাম।আমার মা কুশিকাটার কাজ, বেতের কাজ, জাল বুনা, সেলাই কাজ এসব করতেন; আমি অবাক চোখে দেখতাম আর সাহায্য করতাম। মা চাচিরা অবসরে আগ পিছ বসে চুলে বেনী কাটত। কর্দমাক্ত রাস্তায় একবার জেঠার সাথে কাঠাল কিনতে বাতাইছড়ি বাজার গেচিলাম। কাদা পথে হাটার জন্য জেঠা খরম আর আমার জন্য নাগরা জুতা কিনেছিল। খাল বিলে তখন প্রচুর মাছ হতো। বড়রা জাল মারত আর ছোটরা ডুলা ধরত। বরুড়া বাজারে ইলিশ মাছ মাথায় নিয়ে বেচত, তখন অফ সিজনে টিনে ভরা নোনা ইলিশ পাওয়া যেত। বর্ষায় অতিবৃষ্টিতে মাছের জোয়া লাগলে আনতা পাততাম, চাই দিয়ে মাছ ধরতাম। শীতকালে দীঘিতে বোয়াল মাছ ধরতে বরশি পাততাম, ঘন কুয়াশায় দলবেঁধে মাছের আশায় রাত জাগতাম।অনেক সময় এতো মাছ হতো যে কুটে শেষ করা যেতনা,পচে যাবার ভয়ে শুটকি করতে হতো। তখন লবণের পোটলা আর সুতায় ঝুলানো বোতলে কেরাসিন নিয়ে বাজার থেকে বাড়ি ফিরত গ্রামের মানুষ। ঝোপের আড়ালে মল ত্যাগের অভ্যাস মানুষের এখন আর নেই। মনে পড়ে সেই সময় বরুড়া থেকে মুড়ির টিনে কুমিল্লা শহরে বেড়াতে গিয়েছিলাম।
আমরা কুপি-হারিকেনের আলোয় পড়তাম।সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলে ঘরে ফিরে পড়তে বসতাম। শব্দ করে পড়তে হতো। পড়া শেষে খেয়ে বোনের বিছুনের বাতাসে ঘুমাতাম।তখন মিটমিট আলো দিত বোতলে ভরা জোনাকির দল।তারাভরা আধার রাতে উঠোনের বিছানায় দাদির কাছে কল্পলোকের কিচ্ছা শুনতে শুনতে অজান্তেই ঘুম এসে যেত।আশপাশের গ্রামে কবিগান, যাত্রাপালা, ওয়াজ মাহফিল কিংবা পুড়ধরার আসর বসতো। নিশুতি রাতে সংগী নিয়ে চুপিসারে দেখে আসতাম।গ্রামের জোছনা অপার, জোনাকির ঝিকিমিকি অথবা অপেক্ষার বৃষ্টির পর শত ব্যাংগের কোলাহল আর শুনিনা, দেখিনা। ফসলের মাঠ ভেংগে কাসেড্ডায় স্কুলের পথে মটরশুঁটি ক্ষেতে লুটোপুটি আর তিল ফুলে মৌমাছি ধরতে যেয়ে হুল ফুটানোর স্মৃতিতো ভুলার নয়।প্রাইমারিতে বার্ষিক ক্রীড়ার স্মৃতিই সবচেয়ে মনে পড়ে। ব্রেক এ পাশের হিন্দু বাড়িতে বন্ধুরাসহ হাটতে যেয়ে ফলভর্তি গাছ দেখতাম, সুস্বাদু নারিকেলের নাড়ু খাবারও অভিজ্ঞতা হয়েছে। মহেশপুর স্কুলে বৃত্তির পড়ার জন্য রাতে দলবেঁধে হোষ্টেলে থাকতাম, পালাক্রমে স্যারের জন্য খাবার নিয়ে যাবার দায়িত্ব ছিলো সেই বয়সে।
ছোট বেলায় আমি পালকি চড়ে নাইওর যাবার হাক শুনেছি। প্রচন্ড খরায় দলবেঁধে বাড়ি বাড়ি গিয়ে বৃষ্টির গান গাইতে দেখেছি। নিজে শুনেছি সেহরির জন্য ঘুম ভাংগা দলের গান।
মনে পড়ে,শাহপুরের বৈশাখী মেলায় যেতাম। টেনটেনি কিনে এনে পাড়াজুড়ে ঘুরে ঘুরে বাজাতাম। ডাউস গুন্ডি কিনতাম প্রতি বছর , পরাণ ভরে উড়াতাম, ঘুড়ির পিছনে দৌড়িয়ে কেটে যেত সারাবেলা। একবার বড় একটা হানক গুন্ডি বানিয়েছিলাম , অগোচরে মায়ের পুরনো শাড়ী নিয়ে ঘুড়িটিতে লম্বা লেজ দিয়েছিলাম আর লাগিয়েছিলাম বড় বোয়া।স্বপ্নের সেই ঘুড়ি দূর আকাশে উড়িয়ে বাড়ি এনে খুটিতে বেধে রেখেছিলাম আর গ্রামজুড়ে মধুর সুর দিয়েছিল সেই ঘুড়ি রাতভর। অন্য অনেকের মতো সাইকেলের পরিত্যক্ত চাকা আমিও ঘুড়িয়েছি। স্টিক নিয়ে রিং এর পিছু দৌড়িয়ে কেটেছে আমারও দূরন্ত শৈশব।
আমার মামাবাড়ি গোহালিয়া। আদরের কমতি ছিলো না সেখানে । খেলতে যেয়ে আমি দোষ করলেও মামির বকাটা নিশ্চিতভাবেই খেত মামাত ভাই। ওর সাথে ফাদ পেতে দোয়েল পাখি ধরা আর বেল বেয়ে মাছ ধরার স্মৃতি এখনো তাজা।মামাবাড়ির নিকটেই নিমসার, কাবিলা। কান পাতলেই আসতো দূরগামী সব গাড়ির শব্দ আর কেমন যেন করতো আমার শিশুমন। কৈশোরে ৫ কিলোমিটার দুরের বরুড়া স্কুলে হেঁটে গিয়েছি ; অসম্ভব লাগেনি।
স্কুলে স্কাউটিং এর শিক্ষা গ্রামে কাজে লাগাতাম-রাস্তার গর্ত ভরাট , মসজিদের যত্ন, কচুরিপানা পরিস্কার,অন্ধকে পথ দেখানো এইসব করতাম। ক্লাসে প্রথম হলে, বৃত্তি পেলে বাহবা পেতাম। মা চাচিদের পা ছুয়ে সালাম করতাম। মহিলারা রিক্সায় বেডং দিয়ে চলত। গুরুজনদের দেখলে রাস্তায় সাইকেল থেকে নেমে যেতাম। বিয়েতে জামাই কে বাইসাইকেল উপহার দিত। স্বাধীনতা দিবসের কুচকাওয়াজ , শারীরিক কসরত এর কথা মনে পড়ে আর মনে পড়ে প্রভাত ফেরির অমর গান।
শৈশবে ঈদের ছুটিতে চুপিচুপি বন্ধুরা মিলে লাকসাম, চান্দিনা, ক্যান্টনমেন্ট , কুমিল্লা যেয়ে দলবেঁধে সিনেমা দেখতাম। হলের ভিতর উলুশের কামড় ব্ল্যাক এ যুদ্ধ করে টিকেট কাটার আনন্দ ম্লান করে দিত। আবার ফকিরা বাজারে গরুর লাথি খেয়েও ঈদের গরু নিয়ে বাড়ি ফেরার উতসাহে কোনো ঘাটতি হতোনা।কোরবানির গরুর ভূড়ি দিয়ে ঢোল বানিয়ে বাজাতাম।রমজান আসলে সমবয়সীদের রোজা রাখার প্রতিযোগিতা হতো। ঈদে বোন আর মামী দিত নতুন জুতা-জামা, এই দিয়েই চলে যেত বছর। রমজানের কাঊন্টডাউন শেষে সন্ধ্যায় দলবেঁধে হই হুল্লুর করে ঈদের চাদ দেখতাম - সেই এক ফালি বাকা চাদেই ফিরে ফিরে আসে আমাদের শ্বাসত ঈদ - ঈদ মোবারক!