গাজীউল হক সোহাগ
বৈশাখ এলেই কুমিল্লার হোমনার শ্রীমদ্দি গ্রামের খেটে খাওয়া মানুষগুলোর মুখে হাসি ফুটে। এ বাড়ি ও বাড়িতে প্রতিযোগিতা শুরু হয়। কে কত বাঁশি বানাতে পারবে। কার চেয়ে কে বেশি বাঁশি বিক্রি করতে পারবে। বছরের অন্য সময়ের তুলনার বৈশাখ এলে হিন্দু পল্লীর বাঁশির কারিগর আর মালিকদের আনন্দের বন্যা বয়ে যায়। নববর্ষের প্রথম দিনেই তাঁদের তৈরি বাঁশি ছড়িয়ে পড়ে গ্রাম থেকে শহরে। এক শহর থেকে আরেক শহরে। এভাবে পুরো দেশেই চলে যাচ্ছে হোমনার বাঁশি। ঐতিহ্যবাহী হোমনার বাঁশির কদর তাই পুরো দেশ জুড়েই। ওই বাঁশি বিক্রি করেই তাঁরা জীবন যাপন করছেন।
সরেজমিনে কুমিল্লার হোমনা উপজেলার শ্রীমদ্দি গ্রামের হিন্দু পল্লিতে গিয়ে দেখা গেছে, বাঁশি তৈরিতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন কারিগর ও শিল্পীরা। নারী-পুরুষ একই কাতারে বসে বাঁশি তৈরি করছেন। কেউ কয়লার আগুনে লোহা গরম করছেন। কেউ ওই লোহা দিয়ে বাঁশির ছিদ্র করছেন। কেউ তুলির আঁচড় দিচ্ছেন। কেউ বা গুনে গুনে বস্তায় ভরছেন। এ এক এলাহি কান্ড!
হোমনা পৌরসভার শ্রীমদ্দি গ্রাম। উপজেলা সদর থেকে প্রায় দুইকিলোমিটার পশ্চিমে তিতাস নদীর তীরে এর অবস্থান। পাড়ার উঠোন ও নানা ধরণের গলির মধ্যে বাঁশ ছড়ানো ছিটানো আছে। এই গ্রামের জজ মিয়া দৈনিক ১০০ টির মতো বাঁশি বানান।
স্থানীয় বাঁশি প্রস্তুতকারক আবুল কাশেম বলেন, মোহন বাঁশি, তোতা বাঁশি, খানদানি বাঁশি, আড় বাঁশি, ফেন্সি বাঁশি, বেলুন বাঁশি, বীণ বাঁশি তৈরি হয় এখানে। এই বাঁশি চাঁদপুরের কচুয়া উপজেলার সাচারমেলা,মতলবের বেলতলির লেংটার মেলা, লাঙ্গলবন্দের অষ্টমী স্নান, ধামরাইয়ের রথমেলা, চট্রগ্রামের জব্বারের বলীখেলা, লালন উৎসব, সুলতান উৎসব, শচীন মেলায় বিক্রি হয়।
জানা গেছে, চট্টগ্রাম ও ভারতীয় সীমান্তবর্তী এলাকা থেকে চিকন আকৃতির বাঁশ কিনে আনেন তাঁরা। এরপর ওই বাঁশ রোদে শুকিয়ে বাঁশি তৈরির উপযোগী করা হয়। একটি বাঁশ থেকে কমপক্ষে পাঁচটি বাঁশি বানানো হয়। প্রতি বাঁশের দাম দশ টাকা। আর বঙ্গ আকৃতির একটি বাঁশির দাম পড়ে ১০/১২ টাকা। ছোট বাঁশির দাম ১০ টাকা। তবে মোহন বাঁশির দাম ১৫- ২০ টাকা, মুখ বাঁশি ৮-১০ টাকা, নাগিনী বাঁশি ১০-১৫ টাকা, পাখি বাঁশি ৮-১০ টাকা দরে বিক্রি হয়। বাঁশ আনানেওয়া খরচ ও কয়লার দাম বেড়ে যাওয়ার আগের মতো লাভ হচ্ছে না বলে কারিগররা জানিয়েছেন।
শ্রীমদ্দি গ্রামের শশীমোহন বিশ্বাস। তাঁর বয়স যখন ৯০ বছর ছিল তখন তিনি জানিয়েছিলেন, 'আমার জন্মের পর থেকে দেখছি এ গ্রামে বাঁশি বানানো হচ্ছে। ওই বাঁশি শিশুদের বিনোদনের জন্য মেলায় নিয়ে যাওয়া হতো। এখন মেলার সংখ্যা কমে গেছে। ঐতিহ্যও হারিয়ে যেতে বসেছে। তারপরও গ্রামের মানুষের তৈরি বাঁশি দেশের বাইরেও বিক্রি হচ্ছে।
শ্রীমন্দি গ্রামের কয়েকজন বাসিন্দা জানান, সারা বছরই আমরা বাঁশি বানিয়ে থাকি। ওই বাঁশি বিভিন্ন মেলা উপলক্ষে বিক্রি করা হয়। একটি ছোট আকৃতির বাঁশ থেকে পাঁচটি বাঁশি বানানো যায়।
একই গ্রামের জীবন চন্দ্র বিশ্বাস ও তাঁর স্ত্রী সাহারী চন্দ্র বিশ্বাস বলেন, 'আমাদের পুঁজি নেই। তাই অন্যেও কাজ করে থাকি। এক্ষেত্রে ১০০ বাঁশি তৈরি করে দিলে ৫০ টাকা পাই। প্রতিদিন কমপক্ষে এক হাজার বাঁশি বানানো যায়। তবে বাঁশি তৈরি করে আগের মতো লাভ হয় না এমন মন্তব্য করলেন নিরঞ্জন সরকার । তিনি বলেন, বাঁশের দাম ও রঙের দাম বেড়ে যাওয়ার আগের মতো লাভ হচ্ছে না। তারপরও বাপ-দাদার ঐতিহ্যকে টিকিয়ে রাখার জন্য দিন-রাত পরিশ্রম করে বাঁশি বানাই। এক্ষেত্রে সুদে এবং কিস্তিতে টাকা মনে বাঁশ কিনতে হয়। সারা বছরই আমরা বাঁশি বানিয়ে থাকি।
একই গ্রামের সবি রাণী সরকার ও অনিতা রাণী সরকার জানান “তৈরিকৃত বাঁশি পহেলা বৈশাখের দিন রমনার বটমুলের মেলায় যায়। বিভিন্ন স্থানের মেলায় বাঁশি বিক্রি করা হবে।
শ্রীমদ্দি গ্রামের যতীন্দ্র চন্দ্র বিশ্বাস বলেন, শ্রীমদ্দি গ্রামের বাঁশি আমরা সিঙ্গাপুর, বৃটেন, জাপান, জার্মানি, নেদারল্যান্ড, ফ্রান্স ও যুক্তরাষ্ট্রসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে রপ্তানি করে থাকি। বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের সঙ্গে যাঁরা জড়িত তাঁদের কাছে ওই বাঁশি বিদেশে রপ্তানির জন্য পৌঁছানো হয়। এই বাঁশি বিক্রি করে আমার পরিবার স্বাবলম্বী হয়েছে।”
রাজধানী ঢাকার শাহবাগ আজিজ সুপার মার্কেটের একজন ব্যবসায়ীর মতে, হোমনার বাঁশের তৈরি নানা উপকরণ ও বাঁশি আমরা কিনে থাকি। পরবর্তীতে সেগুলো বিদেশে বিক্রির জন্য পাঠিয়ে থাকি। হোমনার বাঁশি পুরো দেশের বাঁশির চাহিদা মেটাচ্ছে। শতবর্ষ আগে থেকেই তাঁরা বাঁশি বানিয়ে বিক্রি করছে।
হোমনা উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান মো. জহিরুল হক বলেন, 'যুগ যুগ ধরে শ্রীমদ্দি গ্রামের বাসিন্দারা বাঁশির ঐতিহ্যকে লালন করে আসছে। ওই বাঁশি তৈরি করে তাঁরা আমাদের লোকজ সংস্কৃতিকে বেগবান করছে। একই সঙ্গে নিজেরাও লাভবান হচ্ছে। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা থাকলে শ্রীমদ্দি গ্রামের গরীব মানুষগুলো উপকার পেতো। আজ বাঙালির নববর্ষের প্রথম দিনে শিশুরা খেলনার সঙ্গে হোমনার বাঁশি ঠোঁটে নেবে। শিশুদের কু-কা শব্দে বৈশাখের রঙ ছড়িয়ে পড়বে। এই রঙের বারতার খুশির ঢেকুর তুলবে হোমনার বাঁশি শিল্পীরা।’
হোমনা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ক্ষেমালিকা চাকমা বলেন,‘ এই জনপদের বাঁশির সুনাম আছে। তাঁরা প্রণোদনা চাইলে দেব।
বৈশাখ এলেই কুমিল্লার হোমনার শ্রীমদ্দি গ্রামের খেটে খাওয়া মানুষগুলোর মুখে হাসি ফুটে। এ বাড়ি ও বাড়িতে প্রতিযোগিতা শুরু হয়। কে কত বাঁশি বানাতে পারবে। কার চেয়ে কে বেশি বাঁশি বিক্রি করতে পারবে। বছরের অন্য সময়ের তুলনার বৈশাখ এলে হিন্দু পল্লীর বাঁশির কারিগর আর মালিকদের আনন্দের বন্যা বয়ে যায়। নববর্ষের প্রথম দিনেই তাঁদের তৈরি বাঁশি ছড়িয়ে পড়ে গ্রাম থেকে শহরে। এক শহর থেকে আরেক শহরে। এভাবে পুরো দেশেই চলে যাচ্ছে হোমনার বাঁশি। ঐতিহ্যবাহী হোমনার বাঁশির কদর তাই পুরো দেশ জুড়েই। ওই বাঁশি বিক্রি করেই তাঁরা জীবন যাপন করছেন।
সরেজমিনে কুমিল্লার হোমনা উপজেলার শ্রীমদ্দি গ্রামের হিন্দু পল্লিতে গিয়ে দেখা গেছে, বাঁশি তৈরিতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন কারিগর ও শিল্পীরা। নারী-পুরুষ একই কাতারে বসে বাঁশি তৈরি করছেন। কেউ কয়লার আগুনে লোহা গরম করছেন। কেউ ওই লোহা দিয়ে বাঁশির ছিদ্র করছেন। কেউ তুলির আঁচড় দিচ্ছেন। কেউ বা গুনে গুনে বস্তায় ভরছেন। এ এক এলাহি কান্ড!
হোমনা পৌরসভার শ্রীমদ্দি গ্রাম। উপজেলা সদর থেকে প্রায় দুইকিলোমিটার পশ্চিমে তিতাস নদীর তীরে এর অবস্থান। পাড়ার উঠোন ও নানা ধরণের গলির মধ্যে বাঁশ ছড়ানো ছিটানো আছে। এই গ্রামের জজ মিয়া দৈনিক ১০০ টির মতো বাঁশি বানান।
স্থানীয় বাঁশি প্রস্তুতকারক আবুল কাশেম বলেন, মোহন বাঁশি, তোতা বাঁশি, খানদানি বাঁশি, আড় বাঁশি, ফেন্সি বাঁশি, বেলুন বাঁশি, বীণ বাঁশি তৈরি হয় এখানে। এই বাঁশি চাঁদপুরের কচুয়া উপজেলার সাচারমেলা,মতলবের বেলতলির লেংটার মেলা, লাঙ্গলবন্দের অষ্টমী স্নান, ধামরাইয়ের রথমেলা, চট্রগ্রামের জব্বারের বলীখেলা, লালন উৎসব, সুলতান উৎসব, শচীন মেলায় বিক্রি হয়।
জানা গেছে, চট্টগ্রাম ও ভারতীয় সীমান্তবর্তী এলাকা থেকে চিকন আকৃতির বাঁশ কিনে আনেন তাঁরা। এরপর ওই বাঁশ রোদে শুকিয়ে বাঁশি তৈরির উপযোগী করা হয়। একটি বাঁশ থেকে কমপক্ষে পাঁচটি বাঁশি বানানো হয়। প্রতি বাঁশের দাম দশ টাকা। আর বঙ্গ আকৃতির একটি বাঁশির দাম পড়ে ১০/১২ টাকা। ছোট বাঁশির দাম ১০ টাকা। তবে মোহন বাঁশির দাম ১৫- ২০ টাকা, মুখ বাঁশি ৮-১০ টাকা, নাগিনী বাঁশি ১০-১৫ টাকা, পাখি বাঁশি ৮-১০ টাকা দরে বিক্রি হয়। বাঁশ আনানেওয়া খরচ ও কয়লার দাম বেড়ে যাওয়ার আগের মতো লাভ হচ্ছে না বলে কারিগররা জানিয়েছেন।
শ্রীমদ্দি গ্রামের শশীমোহন বিশ্বাস। তাঁর বয়স যখন ৯০ বছর ছিল তখন তিনি জানিয়েছিলেন, 'আমার জন্মের পর থেকে দেখছি এ গ্রামে বাঁশি বানানো হচ্ছে। ওই বাঁশি শিশুদের বিনোদনের জন্য মেলায় নিয়ে যাওয়া হতো। এখন মেলার সংখ্যা কমে গেছে। ঐতিহ্যও হারিয়ে যেতে বসেছে। তারপরও গ্রামের মানুষের তৈরি বাঁশি দেশের বাইরেও বিক্রি হচ্ছে।
শ্রীমন্দি গ্রামের কয়েকজন বাসিন্দা জানান, সারা বছরই আমরা বাঁশি বানিয়ে থাকি। ওই বাঁশি বিভিন্ন মেলা উপলক্ষে বিক্রি করা হয়। একটি ছোট আকৃতির বাঁশ থেকে পাঁচটি বাঁশি বানানো যায়।
একই গ্রামের জীবন চন্দ্র বিশ্বাস ও তাঁর স্ত্রী সাহারী চন্দ্র বিশ্বাস বলেন, 'আমাদের পুঁজি নেই। তাই অন্যেও কাজ করে থাকি। এক্ষেত্রে ১০০ বাঁশি তৈরি করে দিলে ৫০ টাকা পাই। প্রতিদিন কমপক্ষে এক হাজার বাঁশি বানানো যায়। তবে বাঁশি তৈরি করে আগের মতো লাভ হয় না এমন মন্তব্য করলেন নিরঞ্জন সরকার । তিনি বলেন, বাঁশের দাম ও রঙের দাম বেড়ে যাওয়ার আগের মতো লাভ হচ্ছে না। তারপরও বাপ-দাদার ঐতিহ্যকে টিকিয়ে রাখার জন্য দিন-রাত পরিশ্রম করে বাঁশি বানাই। এক্ষেত্রে সুদে এবং কিস্তিতে টাকা মনে বাঁশ কিনতে হয়। সারা বছরই আমরা বাঁশি বানিয়ে থাকি।
একই গ্রামের সবি রাণী সরকার ও অনিতা রাণী সরকার জানান “তৈরিকৃত বাঁশি পহেলা বৈশাখের দিন রমনার বটমুলের মেলায় যায়। বিভিন্ন স্থানের মেলায় বাঁশি বিক্রি করা হবে।
শ্রীমদ্দি গ্রামের যতীন্দ্র চন্দ্র বিশ্বাস বলেন, শ্রীমদ্দি গ্রামের বাঁশি আমরা সিঙ্গাপুর, বৃটেন, জাপান, জার্মানি, নেদারল্যান্ড, ফ্রান্স ও যুক্তরাষ্ট্রসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে রপ্তানি করে থাকি। বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের সঙ্গে যাঁরা জড়িত তাঁদের কাছে ওই বাঁশি বিদেশে রপ্তানির জন্য পৌঁছানো হয়। এই বাঁশি বিক্রি করে আমার পরিবার স্বাবলম্বী হয়েছে।”
রাজধানী ঢাকার শাহবাগ আজিজ সুপার মার্কেটের একজন ব্যবসায়ীর মতে, হোমনার বাঁশের তৈরি নানা উপকরণ ও বাঁশি আমরা কিনে থাকি। পরবর্তীতে সেগুলো বিদেশে বিক্রির জন্য পাঠিয়ে থাকি। হোমনার বাঁশি পুরো দেশের বাঁশির চাহিদা মেটাচ্ছে। শতবর্ষ আগে থেকেই তাঁরা বাঁশি বানিয়ে বিক্রি করছে।
হোমনা উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান মো. জহিরুল হক বলেন, 'যুগ যুগ ধরে শ্রীমদ্দি গ্রামের বাসিন্দারা বাঁশির ঐতিহ্যকে লালন করে আসছে। ওই বাঁশি তৈরি করে তাঁরা আমাদের লোকজ সংস্কৃতিকে বেগবান করছে। একই সঙ্গে নিজেরাও লাভবান হচ্ছে। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা থাকলে শ্রীমদ্দি গ্রামের গরীব মানুষগুলো উপকার পেতো। আজ বাঙালির নববর্ষের প্রথম দিনে শিশুরা খেলনার সঙ্গে হোমনার বাঁশি ঠোঁটে নেবে। শিশুদের কু-কা শব্দে বৈশাখের রঙ ছড়িয়ে পড়বে। এই রঙের বারতার খুশির ঢেকুর তুলবে হোমনার বাঁশি শিল্পীরা।’
হোমনা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ক্ষেমালিকা চাকমা বলেন,‘ এই জনপদের বাঁশির সুনাম আছে। তাঁরা প্রণোদনা চাইলে দেব।