ডা. মো. আরিফ মোর্শেদ খান
নিজের মা'কে নিয়ে লিখতে গেলে প্রথমেই আবেগ এসে বাঁধাগ্রস্ত করে! নির্মোহ লেখা অনেক ক্ষেত্রেই সম্ভব হয় না, কারণ কোথায় শুরু করব, কোথায় শেষ করব, তার কুলকিনারা করা প্রতিটি রক্তমাংসের মানুষের জন্যই কঠিন হয়ে পড়ে!
তারপরও ছোট করে কোন একটা দিকের বিষয়ে আলোকপাত করতে গেলে, একটা কথা বলতে হয়, সমাজের তুলনামূলকভাবে বঞ্চিত শ্রেণীর প্রতি আমার মা, প্রফেসর জোহরা আনিসের আন্তরিক ভালোবাসা, দরদ ও সহানুভূতির অকৃত্রিম প্রকাশের কথা, তাদেরকে সাধ্যমত সাহায্য করার কথা।
একটা ছোট্ট ঘটনার কথা বলি।
আমি যখন ঢাকা মেডিকেল কলেজে পড়ি, স্নাতক ও ইন্টার্নশিপ মিলিয়ে সর্বমোট ছয় বছরেরও দীর্ঘ সময় ঢাকার বকশিবাজারস্থ ডা. ফজলে রাব্বী হল ও ডা. মিলন ইন্টার্ন হোস্টেলে কাটিয়েছি। ঢাকায় বিভিন্ন কাজে গেলে মামনি আমাদের হলে আমাকে দেখার জন্য ঢুঁ মারতেন। পুরো হলের ব্লক বিল্ডিং ও মেইন বিল্ডিংয়ের সব চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী ( ক্লিনার, দারোয়ান, গার্ড ইত্যাদি) থেকে শুরু করে চান মিয়ার চায়ের দোকানের কর্মচারী, দোকানদারদের মধ্যেও একটা ফুরফুরে, গর্বিত ও সতেজ ভাব বিরাজ করতো! কেন? মামনি নিজ থেকে নিজের শিক্ষক পরিচয় দিয়ে খুব সুন্দরভাবে পরম মমতামাখা গলায় তাদের সবার সাথে হাসিমুখে কথা বলতেন, কর্মচারীদের নাম-ধাম, কুশলাদি জানতে চাইতেন, 'তোমরা কেমন আছো' বলে হাত উপরে তুলে হাসি দিয়ে প্রশ্ন করতেন, গল্প করতেন, কারো কারো মাথায় হাত বুলিয়ে দিতেন।
একদিন বিকেলে হলের ভেতরে চাঁনমিয়ার চায়ের দোকানে বন্ধুদের সাথে বসে বৈকালিক চা নাস্তা করছি। আমাদের একজন দারোয়ান ( তার নাম ছিলো বশির) এসে সবার সামনে আমাকে বললো, "স্যার, খালাম্মায় ( আমার মা) আপনেরে কদ্দুর আদর করে, বরং আপ্নের চেয়ে বেশি আমার জন্য উনার দরদ! খালাম্মায় যখন কথা কয়, একদম নিজের ছেলের মত! এত আপন করে তো কেউ কখনো বলে না!" - আমি ও আমার বন্ধুরা লক্ষ করলাম, আবেগে তার গলাটা কিছুটা ধরে এসেছে। হয়তো আমাদের বশির ছোটবেলায় মা'কে হারিয়েছে বলেই এত বেশি আবেগাপ্লুত হয়ে যেত মামণির সাথে কথা বলার সময়।
বন্ধুদের সামনে কিছুটা অপ্রস্তুত অবস্থা সৃষ্টি হতে যাচ্ছিল, কিন্তু তার মধ্যেই আমার বন্ধুরা প্রায় একযোগে সায় দিয়ে বশিরকে বললো, এ অভিজ্ঞতা শুধু তোমার না। আমাদের সবার ক্ষেত্রেই আরিফের আম্মার বিষয়ে এমন বক্তব্য প্রযোজ্য!"
আমাদের স্কুলজীবনেও শৈশবে দেখেছি একই ব্যাপার - অন্য অভিভাবকরা যখন শুধুমাত্র স্কুলের শিক্ষকদের সাথেই কথা বলতেন, মামণি কিন্তু শিক্ষকদের সাথে সাথে সমগুরুত্ব নিয়ে পিয়ন, দারোয়ান, দপ্তরিদের সাথে ওয়ান টু ওয়ান (ড়হব ঃড় ড়হব) ব্যক্তিগতভাবে কুশলাদি জিজ্ঞাসা করতেন, ভালো-মন্দ জানতে চাইতেন, ছোটখাটো সমস্যায় সাহায্য করতেন। বিষয়টা এতই আন্তরিক ছিল যে, স্টাফরা নির্মল আনন্দ পেতো, গর্বভরে বুক ফুলিয়ে বিষয়টি সবাইকে জানান দিত।
আমাদের ছেলেবেলায় কখনো স্কুলে আসলে আরেকটা কাজ করতেন। টিফিনের সময় বা কখনো দুই ক্লাসের ফাঁকে শ্রেণিকক্ষে আসার সুযোগ পেলে অন্য অভিভাবকের মতো নিজ সন্তানের সাথে অর্থাৎ শুধু আমার সাথে কথা বলে চলে যেতেন, তা নয়। হঠাৎ করে বলা নেই, কওয়া নেই, পুরো ক্লাসকে উদ্দেশ্য করে প্রশ্ন করে বসতেন, 'তোমরা পড়াশোনা ঠিকমতো করছো তো? বাবা-মার সেবা করোতো ঠিকমতো? প্রতিদিন শিক্ষকদের দেয়া পাঠ ঠিকমতো শেষ করছো তো? - ইত্যাদি প্রশ্ন! ছাত্রজীবন সঠিকভাবে কাজে না লাগালে কী ক্ষতি হবে, তা নিয়ে বিভিন্ন উপদেশ!!
হায় আল্লাহ! লজ্জায় আমার চোখ নিচে নামতো! বলা বাহুল্য, আমার বন্ধুরা নির্মল আনন্দ পেতো, সকলের কমন অভিভাবক হিসাবেই মামণিকে মূল্যায়ন করতো !
এই যে শুধুমাত্র নিজের সন্তানকে নিয়ে ব্যস্ত না থেকে, ক্লাসের সকল সন্তানের সুস্থ বিকাশের দিকে সমানভাবে মনোযোগ দেয়া, বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর মঙ্গল কামনা, সহানুভূতি দেখানো - বিষয়টি, নির্মোহভাবে যদি বলি, আমার কাছে অত্যন্ত বড় ব্যাপার বলেই মনে হয়। কারণ, অধিকাংশ মানুষের মাঝেই এমনটি সচরাচর দেখা যায় না, ব্যস্ত নাগরিক জীবনে আমরা সবাই অনেকটা "আমি ও আমার পরিবার" এরকম আত্মকেন্দ্রিকতার মাঝেই ডুবে থাকি!
আমার প্রায়শই মনে হয় যে, শুধুমাত্র অনেক সাধারণ মানুষের আন্তরিক দোয়ার বরকতে মামণি সম্ভবত একটা সফল, সুন্দর, প্রায় পরিপূর্ণ জীবন পেয়েছিলেন। মহান আল্লাহতা'য়ালা তার সমস্ত গুনাহ মাফ করে জান্নাত নসিব করুন। আমিন।
ডা. মো. আরিফ মোর্শেদ খান: সহযোগী অধ্যাপক ও ইউনিট চিফ ( ইএনটি ও হেড-নেক সার্জারি বিভাগ), কুমিল্লা মেডিক্যাল কলেজ, কুমিল্লা।
নিজের মা'কে নিয়ে লিখতে গেলে প্রথমেই আবেগ এসে বাঁধাগ্রস্ত করে! নির্মোহ লেখা অনেক ক্ষেত্রেই সম্ভব হয় না, কারণ কোথায় শুরু করব, কোথায় শেষ করব, তার কুলকিনারা করা প্রতিটি রক্তমাংসের মানুষের জন্যই কঠিন হয়ে পড়ে!
তারপরও ছোট করে কোন একটা দিকের বিষয়ে আলোকপাত করতে গেলে, একটা কথা বলতে হয়, সমাজের তুলনামূলকভাবে বঞ্চিত শ্রেণীর প্রতি আমার মা, প্রফেসর জোহরা আনিসের আন্তরিক ভালোবাসা, দরদ ও সহানুভূতির অকৃত্রিম প্রকাশের কথা, তাদেরকে সাধ্যমত সাহায্য করার কথা।
একটা ছোট্ট ঘটনার কথা বলি।
আমি যখন ঢাকা মেডিকেল কলেজে পড়ি, স্নাতক ও ইন্টার্নশিপ মিলিয়ে সর্বমোট ছয় বছরেরও দীর্ঘ সময় ঢাকার বকশিবাজারস্থ ডা. ফজলে রাব্বী হল ও ডা. মিলন ইন্টার্ন হোস্টেলে কাটিয়েছি। ঢাকায় বিভিন্ন কাজে গেলে মামনি আমাদের হলে আমাকে দেখার জন্য ঢুঁ মারতেন। পুরো হলের ব্লক বিল্ডিং ও মেইন বিল্ডিংয়ের সব চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী ( ক্লিনার, দারোয়ান, গার্ড ইত্যাদি) থেকে শুরু করে চান মিয়ার চায়ের দোকানের কর্মচারী, দোকানদারদের মধ্যেও একটা ফুরফুরে, গর্বিত ও সতেজ ভাব বিরাজ করতো! কেন? মামনি নিজ থেকে নিজের শিক্ষক পরিচয় দিয়ে খুব সুন্দরভাবে পরম মমতামাখা গলায় তাদের সবার সাথে হাসিমুখে কথা বলতেন, কর্মচারীদের নাম-ধাম, কুশলাদি জানতে চাইতেন, 'তোমরা কেমন আছো' বলে হাত উপরে তুলে হাসি দিয়ে প্রশ্ন করতেন, গল্প করতেন, কারো কারো মাথায় হাত বুলিয়ে দিতেন।
একদিন বিকেলে হলের ভেতরে চাঁনমিয়ার চায়ের দোকানে বন্ধুদের সাথে বসে বৈকালিক চা নাস্তা করছি। আমাদের একজন দারোয়ান ( তার নাম ছিলো বশির) এসে সবার সামনে আমাকে বললো, "স্যার, খালাম্মায় ( আমার মা) আপনেরে কদ্দুর আদর করে, বরং আপ্নের চেয়ে বেশি আমার জন্য উনার দরদ! খালাম্মায় যখন কথা কয়, একদম নিজের ছেলের মত! এত আপন করে তো কেউ কখনো বলে না!" - আমি ও আমার বন্ধুরা লক্ষ করলাম, আবেগে তার গলাটা কিছুটা ধরে এসেছে। হয়তো আমাদের বশির ছোটবেলায় মা'কে হারিয়েছে বলেই এত বেশি আবেগাপ্লুত হয়ে যেত মামণির সাথে কথা বলার সময়।
বন্ধুদের সামনে কিছুটা অপ্রস্তুত অবস্থা সৃষ্টি হতে যাচ্ছিল, কিন্তু তার মধ্যেই আমার বন্ধুরা প্রায় একযোগে সায় দিয়ে বশিরকে বললো, এ অভিজ্ঞতা শুধু তোমার না। আমাদের সবার ক্ষেত্রেই আরিফের আম্মার বিষয়ে এমন বক্তব্য প্রযোজ্য!"
আমাদের স্কুলজীবনেও শৈশবে দেখেছি একই ব্যাপার - অন্য অভিভাবকরা যখন শুধুমাত্র স্কুলের শিক্ষকদের সাথেই কথা বলতেন, মামণি কিন্তু শিক্ষকদের সাথে সাথে সমগুরুত্ব নিয়ে পিয়ন, দারোয়ান, দপ্তরিদের সাথে ওয়ান টু ওয়ান (ড়হব ঃড় ড়হব) ব্যক্তিগতভাবে কুশলাদি জিজ্ঞাসা করতেন, ভালো-মন্দ জানতে চাইতেন, ছোটখাটো সমস্যায় সাহায্য করতেন। বিষয়টা এতই আন্তরিক ছিল যে, স্টাফরা নির্মল আনন্দ পেতো, গর্বভরে বুক ফুলিয়ে বিষয়টি সবাইকে জানান দিত।
আমাদের ছেলেবেলায় কখনো স্কুলে আসলে আরেকটা কাজ করতেন। টিফিনের সময় বা কখনো দুই ক্লাসের ফাঁকে শ্রেণিকক্ষে আসার সুযোগ পেলে অন্য অভিভাবকের মতো নিজ সন্তানের সাথে অর্থাৎ শুধু আমার সাথে কথা বলে চলে যেতেন, তা নয়। হঠাৎ করে বলা নেই, কওয়া নেই, পুরো ক্লাসকে উদ্দেশ্য করে প্রশ্ন করে বসতেন, 'তোমরা পড়াশোনা ঠিকমতো করছো তো? বাবা-মার সেবা করোতো ঠিকমতো? প্রতিদিন শিক্ষকদের দেয়া পাঠ ঠিকমতো শেষ করছো তো? - ইত্যাদি প্রশ্ন! ছাত্রজীবন সঠিকভাবে কাজে না লাগালে কী ক্ষতি হবে, তা নিয়ে বিভিন্ন উপদেশ!!
হায় আল্লাহ! লজ্জায় আমার চোখ নিচে নামতো! বলা বাহুল্য, আমার বন্ধুরা নির্মল আনন্দ পেতো, সকলের কমন অভিভাবক হিসাবেই মামণিকে মূল্যায়ন করতো !
এই যে শুধুমাত্র নিজের সন্তানকে নিয়ে ব্যস্ত না থেকে, ক্লাসের সকল সন্তানের সুস্থ বিকাশের দিকে সমানভাবে মনোযোগ দেয়া, বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর মঙ্গল কামনা, সহানুভূতি দেখানো - বিষয়টি, নির্মোহভাবে যদি বলি, আমার কাছে অত্যন্ত বড় ব্যাপার বলেই মনে হয়। কারণ, অধিকাংশ মানুষের মাঝেই এমনটি সচরাচর দেখা যায় না, ব্যস্ত নাগরিক জীবনে আমরা সবাই অনেকটা "আমি ও আমার পরিবার" এরকম আত্মকেন্দ্রিকতার মাঝেই ডুবে থাকি!
আমার প্রায়শই মনে হয় যে, শুধুমাত্র অনেক সাধারণ মানুষের আন্তরিক দোয়ার বরকতে মামণি সম্ভবত একটা সফল, সুন্দর, প্রায় পরিপূর্ণ জীবন পেয়েছিলেন। মহান আল্লাহতা'য়ালা তার সমস্ত গুনাহ মাফ করে জান্নাত নসিব করুন। আমিন।
ডা. মো. আরিফ মোর্শেদ খান: সহযোগী অধ্যাপক ও ইউনিট চিফ ( ইএনটি ও হেড-নেক সার্জারি বিভাগ), কুমিল্লা মেডিক্যাল কলেজ, কুমিল্লা।