আবুল হাসানাত বাবুল
১৯৬১। শহরতলি গ্রাম চান্দপুর থেকে অগ্রজ খোকন ভাইসহ রাজগঞ্জের বাসায় গেলাম। শেষ রাতের ট্রেনে মেজ ভাই আবু ইউসুফ শাহজাহান সিলেট থেকে আসেন। সময় ভোর কেটেছে মাত্র। আমাদের অনুমান ঠিক। দোতলা থেকে নেমে এলেন মেজ ভাই। আমাদের উদ্দেশ্যে বললেন, চল গরু কিনতে যাব। আমাদের আর পায় কে? সেদিন ছিল কোরবানি ঈদের দিন। আব্বাকে আগেই জানিয়ে রেখেছিলেন। আব্বা ওপর থেকে নামলেন আমার জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা আবদুল আওয়ালকে নিয়ে। আব্বার হাতে মেজ ভাই একশত টাকার একটি নোট তুলে দিলেন। পাশের দোকানে ছিলেন প্রতিবেশী চাচা গোলাম রসুল। দুই রিক্সায় গেলাম চকবাজার। চার আনা করে ভাড়া। চকবাজার ছিল তখন সাপ্তাহিক হাট। রোববার ও বৃহস্পতিবারে হাট বসতো। ঈদ উপলক্ষে পরপর দুদিন হাট বসার পরেও ঈদের দিন সকালেও হাট বসেছিল। গোলাম রসুল চাচা দরদাম করে একশত টাকায় একটি গরুও কিনে ফেললো। গরুর রশি হাতে নিয়ে দেখলাম গরুর মালিকটি করুণ দৃষ্টিতে গরুটির দিকে তাকিয়ে রয়েছে। তার চোখ দিয়ে টপটপ করে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছিল। আব্বা আমাদের একটু অপেক্ষা করতে বললেন। বুঝালেন গরুটি লালন করেছিল এই কৃষক। বিদায় দিতে গিয়ে বিয়োগব্যথায় বিমর্ষ হয়ে গিয়েছিল। এসব কিছু বুঝবার ক্ষমতা তখন আমার ছিল না। গরু নিয়ে কত তাড়াতাড়ি বাড়ি যাব, এই ছিল উদ্দেশ্য। গোমতীর আইল ধরে গাংচর খেয়াঘাট হয়ে বাড়িতে গেলাম। বাড়ির মহিলা মহলেও উৎসাহ নেমে এলো। আমার বাবা একসময়ে নিয়মিত গরু কোরবানী দিতেন। আমার মা মারা যাবার পর বিভিন্ন কারণে এই ধারাবাহিকতা থেমে গিয়েছিলো। অনেক বছর পর মেজোভাই কোরবানী দেবার ব্যবস্থা করলেন। ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন আমার দাদা। তিনি ছিলেন আমার বাবার চাচা কিন্তু বার্ধক্যে তিনি আমাদের সাথেই থাকতেন। একশত টাকা দাম শুনে অবাক হলেন। বললেন, ১৯৪২ সালে বিশ টাকায় এমন একটি গরু পাওয়া যেতো। গোমতীতে নিয়ে গরু গোসল দিয়ে কোরবানীর জন্য প্রস্তুত রেখেছিলাম। পরের বছরও মেজোভাই বাবাকে একশত টাকা দিয়েছিলেন। হাটে যাবার পথে ৮৭ টাকা দিয়ে সেবার গরু কিনেছিলেন। গতবারের চেয়ে ছোট বলে আমরা মনে মনে নাখোশ ছিলাম। খোকন ভাই ও আমি জিদ করে গরুটি নিয়ে গেলাম। উদ্দেশ্য এটি বিক্রি করে বড় গরু কিনবো। আব্বা আমাদের হাতে আরো বিশ টাকা দিয়ে দিলেন। দুর্ভাগ্যের বিষয় ছিলো তিনজন গরুটি দেখেছিলো কিন্তু ৮৫ টাকার বেশি কেউ বললোনা। খোকন ভাই জিদ করে বললেন এটাই আমাদের কপালে আছে। চল বাড়িতে যাই। তার পরের বছর ৯৫ টাকায় গরু কিনেছিলাম। তারপর একসময় বাবা-মেজোভাইয়ের যুগ গেলো। ১৯৮৫ সালে আমি এবং খোকন ভাই উনিশশত টাকায় কোরবানির গরু কিনলাম। তারপরের বছর দুই হাজার আটশত টাকায় নদীর উত্তর পাড় আমড়াতলি বাজার থেকে গরু কিনেছিলাম। গরু কেনা উপলক্ষে প্রতিবছর বানাশুয়া, শিবের বাজার, নেউরা, দুতিয়ার দীঘির পাড়, চান্দপুর বাজারে যাওয়া-আসা শুরু হলো। ততদিনে আমাদের বড় ভ্রাতুষ্পুত্র রূপক আমাদের সঙ্গে যোগ দিল। ১৯৯৮ সালে বারো হাজার টাকায় গরু কিনলাম। কোরবানী দেবার ধারাবাহিকতা ঠিক থাকলো। গরু কেনায় অনুজদের সাথে ভ্রাতুষ্পুত্ররাও যোগ দিল। প্রতি বছর কোরবানি ঈদে ভ্রাতুষ্পুত্ররা তথ্য দিত অমুক বাজারে কম দামে গরু পাওয়া যাবে। সবাই একমত হয়ে সেই বাজারেই যেতাম। এইভাবে প্রতিবছর বারো থেকে পনেরো, পনেরো থেকে বিশ, বিশ থেকে পঁচিশে উঠে গেলাম। শরিক বাড়লো। ভালোই হলো। খুশি হলাম। কিন্তু ২০১৫ সাল থেকে গরুর দাম লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়লো। কখন যে ৫০ হাজার টাকায় গরু কিনে ফেললো, বুঝতেই পারলাম না। আমিতো আমার সামর্থ্যরে বাইরে যেতে রাজি নই। আমার ভ্রাতুষ্পুত্রও আমার অবস্থা বুঝে আমাকে চাপ দেয় না। গতবার এক লাফে ৯৬ হাজার টাকায় গরু কিনলো। তারপরে ১ লাখ ১০ হাজার টাকায়। পরিতাপের সঙ্গে বলতে হয় প্রতি বছর বেশি দামে গরু কেনা হচ্ছে সত্য। সেবছরও লাখ টাকায় গরু কিনলো ঠিকই। টাকা বহুবহুগুণে বৃদ্ধি পেয়েছে সত্য কিন্তু ১৯৬১ সালে মেজভাই একশত টাকায় যে গরুটি কিনে দিয়েছিলেন বর্তমান সেই গরুটি আকারে-আকৃতিতে একইরকম। অর্থাৎ গরুর সাইজ ৬০ বছর আগেরটার মতই রয়ে গেল। টাকা বাড়লো কিন্তু গরুর সাইজ আর বাড়লো না।
আবুল হাসানাত বাবুল: লেখক, সম্পাদক, সাপ্তাহিক অভিবাদন; সভাপতি, তিননদী পরিষদ
সাবেক সভাপতি, কুমিল্লা প্রেসক্লাব।
১৯৬১। শহরতলি গ্রাম চান্দপুর থেকে অগ্রজ খোকন ভাইসহ রাজগঞ্জের বাসায় গেলাম। শেষ রাতের ট্রেনে মেজ ভাই আবু ইউসুফ শাহজাহান সিলেট থেকে আসেন। সময় ভোর কেটেছে মাত্র। আমাদের অনুমান ঠিক। দোতলা থেকে নেমে এলেন মেজ ভাই। আমাদের উদ্দেশ্যে বললেন, চল গরু কিনতে যাব। আমাদের আর পায় কে? সেদিন ছিল কোরবানি ঈদের দিন। আব্বাকে আগেই জানিয়ে রেখেছিলেন। আব্বা ওপর থেকে নামলেন আমার জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা আবদুল আওয়ালকে নিয়ে। আব্বার হাতে মেজ ভাই একশত টাকার একটি নোট তুলে দিলেন। পাশের দোকানে ছিলেন প্রতিবেশী চাচা গোলাম রসুল। দুই রিক্সায় গেলাম চকবাজার। চার আনা করে ভাড়া। চকবাজার ছিল তখন সাপ্তাহিক হাট। রোববার ও বৃহস্পতিবারে হাট বসতো। ঈদ উপলক্ষে পরপর দুদিন হাট বসার পরেও ঈদের দিন সকালেও হাট বসেছিল। গোলাম রসুল চাচা দরদাম করে একশত টাকায় একটি গরুও কিনে ফেললো। গরুর রশি হাতে নিয়ে দেখলাম গরুর মালিকটি করুণ দৃষ্টিতে গরুটির দিকে তাকিয়ে রয়েছে। তার চোখ দিয়ে টপটপ করে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছিল। আব্বা আমাদের একটু অপেক্ষা করতে বললেন। বুঝালেন গরুটি লালন করেছিল এই কৃষক। বিদায় দিতে গিয়ে বিয়োগব্যথায় বিমর্ষ হয়ে গিয়েছিল। এসব কিছু বুঝবার ক্ষমতা তখন আমার ছিল না। গরু নিয়ে কত তাড়াতাড়ি বাড়ি যাব, এই ছিল উদ্দেশ্য। গোমতীর আইল ধরে গাংচর খেয়াঘাট হয়ে বাড়িতে গেলাম। বাড়ির মহিলা মহলেও উৎসাহ নেমে এলো। আমার বাবা একসময়ে নিয়মিত গরু কোরবানী দিতেন। আমার মা মারা যাবার পর বিভিন্ন কারণে এই ধারাবাহিকতা থেমে গিয়েছিলো। অনেক বছর পর মেজোভাই কোরবানী দেবার ব্যবস্থা করলেন। ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন আমার দাদা। তিনি ছিলেন আমার বাবার চাচা কিন্তু বার্ধক্যে তিনি আমাদের সাথেই থাকতেন। একশত টাকা দাম শুনে অবাক হলেন। বললেন, ১৯৪২ সালে বিশ টাকায় এমন একটি গরু পাওয়া যেতো। গোমতীতে নিয়ে গরু গোসল দিয়ে কোরবানীর জন্য প্রস্তুত রেখেছিলাম। পরের বছরও মেজোভাই বাবাকে একশত টাকা দিয়েছিলেন। হাটে যাবার পথে ৮৭ টাকা দিয়ে সেবার গরু কিনেছিলেন। গতবারের চেয়ে ছোট বলে আমরা মনে মনে নাখোশ ছিলাম। খোকন ভাই ও আমি জিদ করে গরুটি নিয়ে গেলাম। উদ্দেশ্য এটি বিক্রি করে বড় গরু কিনবো। আব্বা আমাদের হাতে আরো বিশ টাকা দিয়ে দিলেন। দুর্ভাগ্যের বিষয় ছিলো তিনজন গরুটি দেখেছিলো কিন্তু ৮৫ টাকার বেশি কেউ বললোনা। খোকন ভাই জিদ করে বললেন এটাই আমাদের কপালে আছে। চল বাড়িতে যাই। তার পরের বছর ৯৫ টাকায় গরু কিনেছিলাম। তারপর একসময় বাবা-মেজোভাইয়ের যুগ গেলো। ১৯৮৫ সালে আমি এবং খোকন ভাই উনিশশত টাকায় কোরবানির গরু কিনলাম। তারপরের বছর দুই হাজার আটশত টাকায় নদীর উত্তর পাড় আমড়াতলি বাজার থেকে গরু কিনেছিলাম। গরু কেনা উপলক্ষে প্রতিবছর বানাশুয়া, শিবের বাজার, নেউরা, দুতিয়ার দীঘির পাড়, চান্দপুর বাজারে যাওয়া-আসা শুরু হলো। ততদিনে আমাদের বড় ভ্রাতুষ্পুত্র রূপক আমাদের সঙ্গে যোগ দিল। ১৯৯৮ সালে বারো হাজার টাকায় গরু কিনলাম। কোরবানী দেবার ধারাবাহিকতা ঠিক থাকলো। গরু কেনায় অনুজদের সাথে ভ্রাতুষ্পুত্ররাও যোগ দিল। প্রতি বছর কোরবানি ঈদে ভ্রাতুষ্পুত্ররা তথ্য দিত অমুক বাজারে কম দামে গরু পাওয়া যাবে। সবাই একমত হয়ে সেই বাজারেই যেতাম। এইভাবে প্রতিবছর বারো থেকে পনেরো, পনেরো থেকে বিশ, বিশ থেকে পঁচিশে উঠে গেলাম। শরিক বাড়লো। ভালোই হলো। খুশি হলাম। কিন্তু ২০১৫ সাল থেকে গরুর দাম লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়লো। কখন যে ৫০ হাজার টাকায় গরু কিনে ফেললো, বুঝতেই পারলাম না। আমিতো আমার সামর্থ্যরে বাইরে যেতে রাজি নই। আমার ভ্রাতুষ্পুত্রও আমার অবস্থা বুঝে আমাকে চাপ দেয় না। গতবার এক লাফে ৯৬ হাজার টাকায় গরু কিনলো। তারপরে ১ লাখ ১০ হাজার টাকায়। পরিতাপের সঙ্গে বলতে হয় প্রতি বছর বেশি দামে গরু কেনা হচ্ছে সত্য। সেবছরও লাখ টাকায় গরু কিনলো ঠিকই। টাকা বহুবহুগুণে বৃদ্ধি পেয়েছে সত্য কিন্তু ১৯৬১ সালে মেজভাই একশত টাকায় যে গরুটি কিনে দিয়েছিলেন বর্তমান সেই গরুটি আকারে-আকৃতিতে একইরকম। অর্থাৎ গরুর সাইজ ৬০ বছর আগেরটার মতই রয়ে গেল। টাকা বাড়লো কিন্তু গরুর সাইজ আর বাড়লো না।
আবুল হাসানাত বাবুল: লেখক, সম্পাদক, সাপ্তাহিক অভিবাদন; সভাপতি, তিননদী পরিষদ
সাবেক সভাপতি, কুমিল্লা প্রেসক্লাব।