• কুমিল্লা সিটি করপোরেশন
  • কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়
  • আদর্শ সদর
  • বরুড়া
  • লাকসাম
  • দাউদকান্দি
  • আরও
    • চৌদ্দগ্রাম
    • সদর দক্ষিণ
    • নাঙ্গলকোট
    • বুড়িচং
    • ব্রাহ্মণপাড়া
    • মনোহরগঞ্জ
    • লালমাই
    • চান্দিনা
    • মুরাদনগর
    • দেবীদ্বার
    • হোমনা
    • মেঘনা
    • তিতাস
  • সর্বশেষ
  • রাজনীতি
  • বাংলাদেশ
  • অপরাধ
  • বিশ্ব
  • বাণিজ্য
  • মতামত
  • খেলা
  • বিনোদন
  • চাকরি
  • জীবনযাপন
  • ইপেপার
  • ইপেপার
facebooktwittertiktokpinterestyoutubelinkedininstagramgoogle
স্বত্ব: ©️ আমার শহর

সম্পাদক ও প্রকাশক : মো. গাজীউল হক ভূঁইয়া ( সোহাগ)।

নাহার প্লাজা, কান্দিরপাড়, কুমিল্লা-৩৫০০

ই-মেইল: [email protected]

ফোন: 01716197760

> মতামত

কুমিল্লার খাদি বয়নশিল্পের সংকট উত্তরণে বার্ডের ভূমিকা

শেখ সাইফুর রহমান
প্রকাশ : ১৪ মে ২০২৫, ১৩: ৪৪
logo

কুমিল্লার খাদি বয়নশিল্পের সংকট উত্তরণে বার্ডের ভূমিকা

শেখ সাইফুর রহমান

প্রকাশ : ১৪ মে ২০২৫, ১৩: ৪৪
Photo

কুমিল্লার বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন একাডেমি (বার্ড) ড. শেখ মাসুদুর রহমানের তত্ত্বাবধানে খাদির সুদিন ফেরাতে গত বছর ‘কুমিল্লার হাতে বোনা খাদি শিল্পের বাজার সম্প্রসারণ ও সক্ষমতা উন্নয়ন’ শীর্ষক একটি প্রায়োগিক গবেষণা প্রকল্প হাতে নেয়। এই প্রকল্প নিয়ে দীর্ঘ আলাপ হয় তাঁর সঙ্গে। এছাড়াও তাঁর দেওয়া তথ্যুউপাত্ত এই নিবন্ধ তৈরিতে সহায়ক হয়েছে।

হাতে কাটা সুতায় হাতে চালানো তাঁতে বোনা কাপড়ই খদ্দর বা খাদি। এই কাপড় তৈরির চল আমাদের দেশে বহু আগে থেকেই চলে আসছে। তবে কুমিল্লার খাদি বিশেষ কারণে একটা ব্র্যান্ডে পরিণত হয়েছে। বর্তমানে এই কাপড় ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্যের স্বীকৃতিও পেয়েছে। তবে কুমিল্লার খাদির উন্নয়নে বার্ডুএর রয়েছে বিশেষ ভূমিকা। নতুন এই প্রকল্প যেন পুরনো প্রকল্পেরই নবায়ন।

পটভূমি

বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী কাপড়গুলোর মধ্যে কুমিল্লার খাদি একটি। পুরোনো নথিপত্র ঘেঁটে এর প্রথম খোঁজ পাওয়া যায় ১৭৪৯ সালে। সেই সময়ে ডেভিড প্যাটারসন নামের এক ইংরেজ অফিসার এই অঞ্চলে ভূমি জরিপে এসেছিলেন। সেই সময়ে তিনি এই এলাকার কৃষকদের পরা নিজেদের তৈরি পোশাক দেখে সেই পোশাকের উল্লেখ করেন তাঁর লেখায়। ধরে নেওয়া হয়, তিনি খাদির কথাই বলছিলেন। মাটিতে গর্ত করে তাঁত বসানো হয়। এই তাঁতকে বলা হয় পিটলুম। আর চরকার সাহায্যে হাতে কাটা সুতা দিয়ে তৈরি হয় মূল কাপড়। এই রীতি বহু বছরের পুরোনো। তখন এই কাপড় খাদি নামে অভিহিত ছিল না। কারণ, খাদি বা খদ্দর শব্দটি গুজরাটি। এই শব্দকে বলা যায় বিপণন বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে জনপ্রিয় করা হয়েছে। আমাদের ধারণা, খাদি মানেই মোটা কাপড়। যদিও এই ধারণা সঠিক নয়। কারণ, আমাদের দেশের মেয়েরা কয়েক হাজার বছর আগেই মিহি সুতা হাতে কাটতে পারত। সেই সুতা দিয়ে মসলিন তৈরি হতো। বিলুপ্তির ১৭০ বছর পর পুনরায় সেই মসলিন পুনরুজ্জীবিত হয়েছে।

Screenshot_1

স্বদেশি আন্দোলনে খাদি

যাহোক, কুমিল্লার খাদি মোটা কাপড় হিসেবেই পরিচিত। শিল্পী, সাহিত্যিক ও রাজনীতিকেরা এই কাপড়ের পাঞ্জাবি পরতেন। আর আমার সেটা দেখতেই অভ্যস্ত ছিলাম। যাহোক, কুমিল্লার খাদির সঙ্গে অবশ্য স্বদেশি আন্দোলনের একটি যোগ আছে। স্বদেশি আন্দোলন গতি পেলে ইংরেজদের তৈরি পণ্য বর্জন করা শুরু হয়। ওই সময়ে কবি রজনীকান্ত সেন লিখেছিলেন: মায়ের দেওয়া মোটা কাপড়/ মাথায় তুলে নে রে ভাই;/ দীন-দুঃখিনী মা য়ে তোদের/ তার বেশী আর সাধ্য নাই।/ ঐ মোটা সূতোর সঙ্গে, মায়ের/ অপার স্নেহ দেখতে পাই ;/ আমরা, এমনি পাষাণ, তাই ফেলে ঐ/ পরের দোরে ভিক্ষা চাই।

যাহোক, দেশপ্রেমের জোয়ারে বাড়ে কুমিল্লার খাদির চাহিদা। কেবল পোশাক নয় কুমিল্লার মুরাদনগর, বাঞ্ছারামপুর, গৌরীপুরে তৈরি শাড়ি, চাদর আর রুমালও ছিল চাহিদার শীর্ষে। ১৯২১ সালে মহাত্মা গান্ধীর অসহযোগ আন্দোলন এই পালে আরও হাওয়া দেয়। গঠন করা হয় ‘নিখিল ভারত তন্তুবায় সমিতি’। অনেকেই তখন চরকায় সুতা কেটে নিজেদের কাপড় নিজেরা তৈরি করতে শুরু করেন। ব্রিটিশদের কারখানায় তৈরি চকচকে কাপড়ের ভিড়েও খাদি দেশীয় কাপড় হিসেবে জায়গা ধরে রাখে। ব্রিটিশ পণ্যের ওপর নির্ভরতা কমিয়ে মানুষকে স্বাবলম্বী করে তোলাই ছিল এর মূল উদ্দেশ্য। নিখিল ভারত তন্তুবায় সমিতির এই উদ্দেশ্য সফল হয়। এর একটি শাখা স্থাপিত হয় কুমিল্লার অভয় আশ্রমে। ফলে কুমিল্লা অঞ্চলের তাঁতিদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হয়। এখানকার খাদি রপ্তানি হতো কলকাতা ও বোম্বের (বর্তমানে মুম্বাই) মতো শহরে। তবে ১৯৪৭ সালে ভারত ভাগের পর নিখিল ভারত তন্তুবায় সমিতি তখন এই অঞ্চলে তাদের পৃষ্ঠপোষকতা চালিয়ে যেতে অসম্মতি জানালে প্রায় পাঁচ হাজার তাঁতি কর্মহীন হয়ে পড়েন।

images.jpeg

ত্রাতা যখন আখতার হামিদ খান

ভারত ভাগের প্রায় এক যুগ পর কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের অধ্যক্ষ ড. আখতার হামিদ খান খাদিকে পুনরুজ্জীবিত করার জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেন। তৎকালীন সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে গ্রামীণ ও কৃষি উন্নয়ন বাজেট থেকে তাঁকে পাঁচ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়।

পাশাপাশি কাটুনি, বয়নশিল্পী ও অন্যান্য কারুশিল্পী সংগঠিত করে প্রয়োজনীয় কার্যক্রম পরিচালনার জন্য একটি স্বায়ত্তশাসিত, বেসরকারি ও অলাভজনক সংগঠন প্রতিষ্ঠারও অনুমোদন দেওয়া হয়। এরপর ১৯৫৬ সালে তাদের অনুদান দেওয়া হয়। কুমিল্লার খদ্দর পুনরুজ্জীবিত করতে এই কর্মসূচির আওতায় বিভিন্ন অঞ্চলে আটটি স্পিনিং সেন্টার, একটি উৎপাদনকেন্দ্র এবং তিনটি প্রশিক্ষণকেন্দ্র স্থাপন করা হয়। ১৯৫৬-৫৭ থেকে ১৯৬১-৬২ সাল পর্যন্ত খাদি সমিতি লোকসান দিলেও পরবর্তী প্রায় ১০ বছর, অর্থাৎ ১৯৬২-৬৩ থেকে ১৯৬৯-৭০ সাল পর্যন্ত প্রতিবছরই মুনাফা করেছে। এ সময়ে সমিতির মুনাফার পরিমাণ ছিল ৪২ হাজার ৭৭৮ টাকা। কুমিল্লার খদ্দর ড. আখতার হামিদ খানের প্রচেষ্টায় নতুনভাবে ফিরে আসে।

এরপর ১৯৫৭ সালের দিকে ড. খানের ব্যক্তিগত উদ্যোগে ভারত থেকে তিনটি অম্বর চরকা এবং তাঁতিদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য একজন দক্ষ কারিগর আনা হয়। অম্বর চরকা খাদি বস্ত্র উৎপাদনে ভালো ফল দেওয়ায় এমন একটি প্রকল্পের আওতায় পুরো বিষয়কে নিয়ে আসা হয়। সে সময় প্রায় ৪০০ অম্বর চরকা ভারত থেকে আমদানি করে খাদি সমিতিকে দেওয়া হয়েছিল। এভাবেই কুমিল্লার খাদি নতুন করে শুরু হয়ে আজও টিকে আছে।

খাদির বর্তমান সংকট

এখানে একটি বিষয় মনে রাখা প্রয়োজন, খাদি কাপড় তৈরির অন্যতম উপকরণ হলো সুতা। ঐতিহ্যগতভাবে হাতে বোনা সুতা দিয়ে দিয়ে খাদি কাপড় তৈরি করতে পরলে সেটা খুবই নরম ও আরামদায়ক হয়। তবে খাদি কাপড় তৈরিতে খাদিশিল্পীরা পারদর্শী হলেও তাঁরা চরকার সাহায্যে সুতা তৈরির কাজে যুক্ত নন। খাদি কাপড় বুননে প্রথাগতভাবে তাঁরা সুতা কাটা নারী শ্রমিকের বা কাটুনিদের ওপর নির্ভর করেন, যাঁরা পার্শ্ববর্তী চান্দিনা, মাধাইয়া, কলাগাঁও এবং অন্যান্য গ্রামে বসবাস করেন। বিবাহিত, স্বামী পরিত্যক্তা, বিধবা ও বয়স্ক নারীরা সাধারণত তুলা দিয়ে সুতা কাটার কাজে নিযুক্ত।

পরিশ্রমের তুলনায় পারিশ্রমিক অনেক কম হওয়ায় কাটুনিরা তাঁদের কাজের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে অন্য কাজে যুক্ত হয়ে পড়ছেন। এ জন্য সর্বাগ্রে মেশিননির্ভর সুতার স্থলে চরকার সাহায্যে সুতা তৈরির প্রতি মনোনিবেশ করতে হবে। এ জন্য উন্নত মানের তুলা সরবরাহের মাধ্যমে তাঁদের দিয়ে পুনরায় উন্নত মানের সুতা দিয়ে নিখাদ খাদিপণ্য তৈরি করতে হলে তাঁদের ব্যাপক আকারে প্রশিক্ষণ দিতে হবে। এ বিষয়ে বাংলাদেশ তুলা উন্নয়ন বোর্ড, বাংলাদেশ তাঁত বোর্ড, বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনসহ অন্যান্য সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে প্রয়োজনীয় সহায়তা গ্রহণ করা যেতে পারে। এসব উদ্যোগের ঘাটতির ফলে হাতে বোনা খাদি কাপড়ের বিশেষ কদর থাকলেও তাদের জন্য পৃথক ধরনের গ্রাহক ও বাজারব্যবস্থা না থাকায় হস্তনির্ভর খাদিশিল্পের অস্তিত্ব আজ হুমকির মুখে। অথচ আজও খাদি কাপড় বলতে হাতে কাটা সুতা ও হাতে বোনা খাদি কাপড়কে বোঝানো হয়, এখনো দেশীয় বাজারে কুমিল্লার আদি খাদির বিপুল চাহিদা রয়েছে। এমনকি বিশ্বব্যাপীও হাতে বোনা খাদি কাপড় ব্যাপকভাবে সমাদৃত। তবে প্রয়োজনীয় কাঁচামাল, হাতে বোনা সুতার জোগান এবং বিপণন ব্যবস্থাপনার অপ্রতুলতার কারণে খাদিশিল্পীরা ঐতিহ্যবাহী এই শিল্পের প্রসারে ভূমিকা রাখতে পারছেন না। হাতে বোনা সুতার জোগানের অভাবে মেশিনের তৈরি সুতা দিয়ে মিলের কাপড়ের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে আপ্রাণ চেষ্টা করছেন খাদিশিল্পীরা। বর্তমানে কুমিল্লার চান্দিনা, দেবীদ্বার ও হোমনায় ৫৬ থেকে ৬০টি ঘরে খাদির তাঁত আছে। কুমিল্লা শহর ও আশপাশের এলাকায় ১২০টি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানসহ সারা দেশে আনুমানিক ৫০০টি প্রতিষ্ঠান খাদি বস্ত্র বিক্রি করছে।

ব্যক্তিগত উদ্যোগে কিছু ব্যবসায়ী আধুনিক ফ্যাশনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে খাদিপণ্যের ডিজাইনে বৈচিত্র্য আনার চেষ্টা করছেন। তবে এ শিল্পের গতিশীলতা নিশ্চিত করতে সরকারের পক্ষ থেকে কোনো সুস্পষ্ট পরিকল্পনা নেই। সরকার ঋণের বিশেষ সুবিধা কিংবা তুলা আমদানির ক্ষেত্রে সহায়তাও দিচ্ছে না। ফলে ঐতিহ্যবাহী খাদিশিল্প বর্তমানে সংকটের মুখে।

খাদিপণ্যের প্রসারে প্রয়োজন দক্ষ কারিগরের। এ জন্য গড়ে ওঠেনি কোনো সরকারি প্রশিক্ষণকেন্দ্র। রপ্তানিসুবিধা, বাজার তৈরি, প্রচার ও মূল্য নির্ধারণে সরকারের উদ্যোগ চোখে পড়ার মতো নয়। বাংলাদেশের তুলনায় পাশের দেশ ভারত, শ্রীলঙ্কা, চীন ও মিয়ানমারে খাদি ও অন্যান্য বস্ত্রশিল্পে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় উন্নয়ন বেশ তরান্বিত হয়েছে বলে অভিমত ব্যক্ত করেছেন বার্ডের পরিচালক শেখ মাসুদুর রহমান।

সম্ভাবনা

শেখ মাসুদুর রহমান মনে করেন, শত প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও কুমিল্লার খাদির রয়েছে বিশাল সম্ভাবনা। বর্তমানে জেনুজি প্রজন্মের ফ্যাশনের প্রতি আগ্রহ এবং বৈচিত্র্যময় পোশাকরুচি খাদিশিল্পের জন্য নতুন দিগন্ত খুলে দিয়েছে। ঢাকার ফ্যাশন হাউসগুলো চাহিদার ভিত্তিতে আধুনিক নকশার আরামদায়ক খাদি পোশাক আনছে বাজারে। এ ধরনের পণ্যের ক্রেতাদের মধ্যে খাদির চাহিদা আরও বাড়ানো গেলে একে টিকিয়ে রাখা সম্ভব।

প্রবীণ খাদি ব্যবসায়ী প্রদীপ কুমার রাহা বলেন, পয়লা বৈশাখে খাদিপণ্যের বিক্রি বাড়ছে। এই ধারা অব্যাহত থাকলে অচিরেই ঈদ বা পূজার বিক্রিকে ছাড়িয়ে যেতে পারবে।

তবে সংশ্লিষ্ট অনেকেরই অভিমত, সম্ভাবনার কারণেই এই শিল্প এখনো টিকে আছে। তবে সরকারি সহায়তা প্রয়োজন। পাশাপাশি বৈচিত্র্যময় ডিজাইন, সৎ নেতৃত্ব এবং সরকারি পৃষ্ঠপোষকতাই কুমিল্লার খদ্দরের হারানো গৌরব ফিরিয়ে আনতে পারবে।

শেখ মাসুদুর রহমান মনে করেন, খাদিপণ্যের উন্নয়ন ও বিপণনব্যবস্থা জোরদার করা জরুরি। শুধু খাদিপণ্য নিয়ে দেশ-বিদেশে প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করা যেতে পারে। সরকারি অফিস, সেনাবাহিনী, ক্যাডেট কলেজ, হাসপাতাল, রেলওয়ে ইত্যাদিতে খাদি কাপড়ে তৈরি চাদর, পর্দা ব্যবহার করার পরামর্শ দেওয়া যেতে পারে।

খাদি একটি পরিবেশবান্ধব, স্বাস্থ্যসম্মত ও টেকসই পণ্য। এর কোনো ক্ষতিকর দিক নেই বললেই চলে। খাদির এই গুণাগুণ দেশে-বিদেশে প্রচারের ব্যবস্থা করার পাশাপাশি, খাদির মানোন্নয়ন, বাজারজাতকরণ ও প্রসার—সবই সম্ভব। এ

ক্ষেত্রে বিদেশে অবস্থিত বাংলাদেশের দূতাবাসগুলো খাদির প্রচারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে বলে মনে করেন তিনি।

জিআই সনদ ও ভবিষৎ পরিকল্পনা

প্রতিষ্ঠানিক অবকাঠামোর উন্নয়ন, যোগ্য নেতৃত্ব, বাস্তবসম্মত পরিকল্পনা ও সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার সমন্বয়ে কুমিল্লার খাদিকে টিকিয়ে রেখে একে বিশ্ব ফ্যাশনেও অন্তর্ভুক্ত করা সম্ভব। আর এই সম্ভাবনাকে মাথায় রেখে বার্ড গত বছর প্রায়োগিক গবেষণা প্রকল্প হাতে নিয়েছে বলে জানান ড. শেখ মাসুদুর রহমান। তিনি বলেন, এখানকার যুগী সম্প্রদায়ে মানুষই বহু বছর ধরে খাদি বুনে আসছেন। তবে খাদিশিল্পের সংকটের কারণে তাঁদের অনেকেই পেশা বদল করেছেন। এখনো যাঁরা আছেন, তাঁদের সংগঠিত করার মধ্যে দিয়েই বার্ড নতুন প্রকল্প শুরু করেছে। ঐতিহ্যগতভাবে কুমিল্লা অঞ্চলের মাটি, জলবায়ু, সুতা কাটা নারী শ্রমিকের সহজলভ্যতা ও বয়নশিল্পীদের দক্ষতার কারণে এখানকার হাতে বোনা খাদির ঘনত্ব, কোমলতা ও শীতলতা একে স্বতন্ত্র করে তোলে। দেরিতে হলেও এসব কারণেই মূলত কুমিল্লার হাতে বোনা খাদি ভৌগোলিক নির্দেশক বা জিআই ট্যাগ পায়, যা আন্তর্জাতিক বাজারে এর মূল্যবৃদ্ধি ও ব্র্যান্ড ভ্যালু তৈরিতে সহায়ক হবে। এ ছাড়া হাতে বোনা খাদিশিল্পী এবং এর সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত নারী শ্রমিকদের কর্মসংস্থান বৃদ্ধিসহ শিল্পটির পুনর্জাগরণে ব্যাপক ভূমিকা রাখতে পারে এই স্বীকৃতি।

উপরন্তু, হাতে বোনা খাদিকে কেন্দ্র করে খাদিপল্লি গড়ে তোলা হলে পর্যটনশিল্পেরও বিকাশ ঘটতে পারে কুমিল্লা অঞ্চলে। তাই জিআই পণ্য হিসেবে কুমিল্লা অঞ্চলের খাদিশিল্প যথাযথ পৃষ্ঠপোষকতা পেলে এটি আমদানিনির্ভর অর্থনীতি থেকে স্বনির্ভর অর্থনীতিতে প্রবেশ করার ক্ষেত্রে যথেষ্ট অবদান রাখতে পারে। এর ফলে একদিকে যেমন লুপ্তপ্রায় ঐতিহ্যবাহী খাদিপণ্যে বৈচিত্র্য ফিরে আসবে, ঠিক তেমনি তরুণ প্রজন্মকেও উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে তুলতে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে। সবচেয়ে ভালো লাগে এই ভেবে যে কুমিল্লার খাদির জিআই গৌরব অর্জনেও রয়েছে বার্ডের ঐতিহাসিক যোগসূত্র; তবে এই প্রক্রিয়ার বাস্তবায়নে কুমিল্লা জেলা প্রশাসনের ভূমিকাকে সাধুবাদ জানিয়েছেন শেখ মাসুদুর রহমান।

Screenshot_5

বার্ডের সময়োপযোগী উদ্যোগ

বার্ডের নতুন প্রকল্প সম্পর্কে বিস্তারিত জানিয়েছে শেখ মাসুদুর রহমান। বলেছেন, কুমিল্লার খাদির ভবিষ্যৎ বিনির্মাণে এখন কাজ করছে বাংলাদেশের পল্লী উন্নয়নের পথিকৃৎ বার্ড। এর উদ্যোগে কুমিল্লায় হস্তচালিত খাদিশিল্পের টেকসই উন্নয়নে হাতে বোনা সুতা ব্যবহার এবং সংশ্লিষ্ট নারী শ্রমিকদের অর্থনৈতিক অংশগ্রহণ বাড়ানোর লক্ষ্যে একটি বিশেষ প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে। প্রকল্পটির আওতায় তুলা উন্নয়ন বোর্ড থেকে সংগৃহীত তুলা দিয়ে গ্রামীণ নারী কাটুনিরা সুতা কাটছেন। সেই সুতা স্থানীয় খাদিশিল্পীদের সরবরাহ করা হচ্ছে। এতে ঐতিহ্যবাহী খাদিপণ্যের গুণগত মান বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং একই সঙ্গে দরিদ্র নারীদের কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করাও সম্ভব হচ্ছে। শুধু তাুই নয়, সুতা তৈরির কাজে নিয়োজিত নারী শ্রমিকেরা প্রথমে ‘ওয়ার্ক বেইজড লার্নিং’ পদ্ধতিতে প্রশিক্ষণের সুযোগ পাচ্ছেন। প্রকল্পটি মূলত কুমিল্লার চান্দিনা উপজেলার সোনাপুর গ্রামের কাটুনি এবং দেবীদ্বার উপজেলার বড়কামতা গ্রামের হস্তনির্ভর বয়নশিল্পীদের মধ্যে পরিচালিত হচ্ছে।

শেখ মাসুদুর রহমান বলেন, এই প্রকল্পের ব্যবস্থাপনায় তুলা উন্নয়ন বোর্ড, নারী শ্রমিক, খাদিশিল্পী, ডিজাইনার ও মিডিয়া প্রতিনিধিদের নিয়ে কম্পোনেন্টুভিত্তিক একটি কাঠামো গড়ে তোলা হয়েছে। মাঠপর্যায়ের কাজ দেখাশোনা করছেন বার্ডের দুজন গ্রাম উন্নয়ন কর্মী এবং সার্বিক দিকনির্দেশনায় রয়েছেন বার্ডের অনুষদবৃন্দ। এ প্রকল্পেরই অংশ হিসেবে শুরুতে দুটি সংগঠন গঠন করা হয়। এতে কাজ করেন মূলত নারী কাটুনি ও বয়নশিল্পীরা। প্রতিটি দলে একজন গ্রাম উন্নয়ন কর্মী নিয়োগ দেওয়া হয়। ফ্যাশন হাউস ‘কারুভূমি’র মাধ্যমে ফিনিশিং প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়। বার্ড ৩০ শতাংশ ও কারুভূমি ৭০ শতাংশ খাদিপণ্যের বিপণনে ভূমিকা রাখছে। এই আয়ের পাশাপাশি আছে গবেষণা ব্যয়। পুরো প্রক্রিয়া খাদির গুণগত মানোয়ন্ন তরান্বিত করবে বলেই আশাবাদী শেখ মাসুদুর রহমান।

এ ছাড়া শেখ মাসুদুর রহমান মনে করেন, এই প্রকল্পের আধুনিকায়ন ঘটেছে এই একটি পদক্ষেপের মাধ্যমে। এই প্রকল্পে ফ্যাশন ডিজাইনার ও কারুশিল্পীদেরও যুক্ত করা হয়েছে, যাতে খাদিপণ্যকে আধুনিক রুচিসম্মতভাবে উপস্থাপন করে ক্রেতাদের মধ্যে এর আবেদন ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়। খাদি পোশাকে নতুন নতুন নকশা ও এর বাজারজাতকরণে তাঁরা সর্বাত্মক সহযোগিতা করছেন। পাশাপাশি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও প্রচারমাধ্যমকে সম্পৃক্ত করে প্রচারণা চালানো হচ্ছে।

বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী খাদিশিল্পকে পুনর্জাগরণ এবং গ্রামীণ অর্থনীতিকে শক্তিশালী করার ক্ষেত্রে এ প্রকল্প একটি কার্যকর ভূমিকা পালন করবে বলে আশাবাদী সবাই। আমদানিনির্ভরতা হ্রাস এবং উদ্যোক্তা তৈরিতে এটি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে পারে।

শেখ সাইফুর রহমান: গবেষক

Thumbnail image

কুমিল্লার বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন একাডেমি (বার্ড) ড. শেখ মাসুদুর রহমানের তত্ত্বাবধানে খাদির সুদিন ফেরাতে গত বছর ‘কুমিল্লার হাতে বোনা খাদি শিল্পের বাজার সম্প্রসারণ ও সক্ষমতা উন্নয়ন’ শীর্ষক একটি প্রায়োগিক গবেষণা প্রকল্প হাতে নেয়। এই প্রকল্প নিয়ে দীর্ঘ আলাপ হয় তাঁর সঙ্গে। এছাড়াও তাঁর দেওয়া তথ্যুউপাত্ত এই নিবন্ধ তৈরিতে সহায়ক হয়েছে।

হাতে কাটা সুতায় হাতে চালানো তাঁতে বোনা কাপড়ই খদ্দর বা খাদি। এই কাপড় তৈরির চল আমাদের দেশে বহু আগে থেকেই চলে আসছে। তবে কুমিল্লার খাদি বিশেষ কারণে একটা ব্র্যান্ডে পরিণত হয়েছে। বর্তমানে এই কাপড় ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্যের স্বীকৃতিও পেয়েছে। তবে কুমিল্লার খাদির উন্নয়নে বার্ডুএর রয়েছে বিশেষ ভূমিকা। নতুন এই প্রকল্প যেন পুরনো প্রকল্পেরই নবায়ন।

পটভূমি

বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী কাপড়গুলোর মধ্যে কুমিল্লার খাদি একটি। পুরোনো নথিপত্র ঘেঁটে এর প্রথম খোঁজ পাওয়া যায় ১৭৪৯ সালে। সেই সময়ে ডেভিড প্যাটারসন নামের এক ইংরেজ অফিসার এই অঞ্চলে ভূমি জরিপে এসেছিলেন। সেই সময়ে তিনি এই এলাকার কৃষকদের পরা নিজেদের তৈরি পোশাক দেখে সেই পোশাকের উল্লেখ করেন তাঁর লেখায়। ধরে নেওয়া হয়, তিনি খাদির কথাই বলছিলেন। মাটিতে গর্ত করে তাঁত বসানো হয়। এই তাঁতকে বলা হয় পিটলুম। আর চরকার সাহায্যে হাতে কাটা সুতা দিয়ে তৈরি হয় মূল কাপড়। এই রীতি বহু বছরের পুরোনো। তখন এই কাপড় খাদি নামে অভিহিত ছিল না। কারণ, খাদি বা খদ্দর শব্দটি গুজরাটি। এই শব্দকে বলা যায় বিপণন বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে জনপ্রিয় করা হয়েছে। আমাদের ধারণা, খাদি মানেই মোটা কাপড়। যদিও এই ধারণা সঠিক নয়। কারণ, আমাদের দেশের মেয়েরা কয়েক হাজার বছর আগেই মিহি সুতা হাতে কাটতে পারত। সেই সুতা দিয়ে মসলিন তৈরি হতো। বিলুপ্তির ১৭০ বছর পর পুনরায় সেই মসলিন পুনরুজ্জীবিত হয়েছে।

Screenshot_1

স্বদেশি আন্দোলনে খাদি

যাহোক, কুমিল্লার খাদি মোটা কাপড় হিসেবেই পরিচিত। শিল্পী, সাহিত্যিক ও রাজনীতিকেরা এই কাপড়ের পাঞ্জাবি পরতেন। আর আমার সেটা দেখতেই অভ্যস্ত ছিলাম। যাহোক, কুমিল্লার খাদির সঙ্গে অবশ্য স্বদেশি আন্দোলনের একটি যোগ আছে। স্বদেশি আন্দোলন গতি পেলে ইংরেজদের তৈরি পণ্য বর্জন করা শুরু হয়। ওই সময়ে কবি রজনীকান্ত সেন লিখেছিলেন: মায়ের দেওয়া মোটা কাপড়/ মাথায় তুলে নে রে ভাই;/ দীন-দুঃখিনী মা য়ে তোদের/ তার বেশী আর সাধ্য নাই।/ ঐ মোটা সূতোর সঙ্গে, মায়ের/ অপার স্নেহ দেখতে পাই ;/ আমরা, এমনি পাষাণ, তাই ফেলে ঐ/ পরের দোরে ভিক্ষা চাই।

যাহোক, দেশপ্রেমের জোয়ারে বাড়ে কুমিল্লার খাদির চাহিদা। কেবল পোশাক নয় কুমিল্লার মুরাদনগর, বাঞ্ছারামপুর, গৌরীপুরে তৈরি শাড়ি, চাদর আর রুমালও ছিল চাহিদার শীর্ষে। ১৯২১ সালে মহাত্মা গান্ধীর অসহযোগ আন্দোলন এই পালে আরও হাওয়া দেয়। গঠন করা হয় ‘নিখিল ভারত তন্তুবায় সমিতি’। অনেকেই তখন চরকায় সুতা কেটে নিজেদের কাপড় নিজেরা তৈরি করতে শুরু করেন। ব্রিটিশদের কারখানায় তৈরি চকচকে কাপড়ের ভিড়েও খাদি দেশীয় কাপড় হিসেবে জায়গা ধরে রাখে। ব্রিটিশ পণ্যের ওপর নির্ভরতা কমিয়ে মানুষকে স্বাবলম্বী করে তোলাই ছিল এর মূল উদ্দেশ্য। নিখিল ভারত তন্তুবায় সমিতির এই উদ্দেশ্য সফল হয়। এর একটি শাখা স্থাপিত হয় কুমিল্লার অভয় আশ্রমে। ফলে কুমিল্লা অঞ্চলের তাঁতিদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হয়। এখানকার খাদি রপ্তানি হতো কলকাতা ও বোম্বের (বর্তমানে মুম্বাই) মতো শহরে। তবে ১৯৪৭ সালে ভারত ভাগের পর নিখিল ভারত তন্তুবায় সমিতি তখন এই অঞ্চলে তাদের পৃষ্ঠপোষকতা চালিয়ে যেতে অসম্মতি জানালে প্রায় পাঁচ হাজার তাঁতি কর্মহীন হয়ে পড়েন।

images.jpeg

ত্রাতা যখন আখতার হামিদ খান

ভারত ভাগের প্রায় এক যুগ পর কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের অধ্যক্ষ ড. আখতার হামিদ খান খাদিকে পুনরুজ্জীবিত করার জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেন। তৎকালীন সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে গ্রামীণ ও কৃষি উন্নয়ন বাজেট থেকে তাঁকে পাঁচ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়।

পাশাপাশি কাটুনি, বয়নশিল্পী ও অন্যান্য কারুশিল্পী সংগঠিত করে প্রয়োজনীয় কার্যক্রম পরিচালনার জন্য একটি স্বায়ত্তশাসিত, বেসরকারি ও অলাভজনক সংগঠন প্রতিষ্ঠারও অনুমোদন দেওয়া হয়। এরপর ১৯৫৬ সালে তাদের অনুদান দেওয়া হয়। কুমিল্লার খদ্দর পুনরুজ্জীবিত করতে এই কর্মসূচির আওতায় বিভিন্ন অঞ্চলে আটটি স্পিনিং সেন্টার, একটি উৎপাদনকেন্দ্র এবং তিনটি প্রশিক্ষণকেন্দ্র স্থাপন করা হয়। ১৯৫৬-৫৭ থেকে ১৯৬১-৬২ সাল পর্যন্ত খাদি সমিতি লোকসান দিলেও পরবর্তী প্রায় ১০ বছর, অর্থাৎ ১৯৬২-৬৩ থেকে ১৯৬৯-৭০ সাল পর্যন্ত প্রতিবছরই মুনাফা করেছে। এ সময়ে সমিতির মুনাফার পরিমাণ ছিল ৪২ হাজার ৭৭৮ টাকা। কুমিল্লার খদ্দর ড. আখতার হামিদ খানের প্রচেষ্টায় নতুনভাবে ফিরে আসে।

এরপর ১৯৫৭ সালের দিকে ড. খানের ব্যক্তিগত উদ্যোগে ভারত থেকে তিনটি অম্বর চরকা এবং তাঁতিদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য একজন দক্ষ কারিগর আনা হয়। অম্বর চরকা খাদি বস্ত্র উৎপাদনে ভালো ফল দেওয়ায় এমন একটি প্রকল্পের আওতায় পুরো বিষয়কে নিয়ে আসা হয়। সে সময় প্রায় ৪০০ অম্বর চরকা ভারত থেকে আমদানি করে খাদি সমিতিকে দেওয়া হয়েছিল। এভাবেই কুমিল্লার খাদি নতুন করে শুরু হয়ে আজও টিকে আছে।

খাদির বর্তমান সংকট

এখানে একটি বিষয় মনে রাখা প্রয়োজন, খাদি কাপড় তৈরির অন্যতম উপকরণ হলো সুতা। ঐতিহ্যগতভাবে হাতে বোনা সুতা দিয়ে দিয়ে খাদি কাপড় তৈরি করতে পরলে সেটা খুবই নরম ও আরামদায়ক হয়। তবে খাদি কাপড় তৈরিতে খাদিশিল্পীরা পারদর্শী হলেও তাঁরা চরকার সাহায্যে সুতা তৈরির কাজে যুক্ত নন। খাদি কাপড় বুননে প্রথাগতভাবে তাঁরা সুতা কাটা নারী শ্রমিকের বা কাটুনিদের ওপর নির্ভর করেন, যাঁরা পার্শ্ববর্তী চান্দিনা, মাধাইয়া, কলাগাঁও এবং অন্যান্য গ্রামে বসবাস করেন। বিবাহিত, স্বামী পরিত্যক্তা, বিধবা ও বয়স্ক নারীরা সাধারণত তুলা দিয়ে সুতা কাটার কাজে নিযুক্ত।

পরিশ্রমের তুলনায় পারিশ্রমিক অনেক কম হওয়ায় কাটুনিরা তাঁদের কাজের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে অন্য কাজে যুক্ত হয়ে পড়ছেন। এ জন্য সর্বাগ্রে মেশিননির্ভর সুতার স্থলে চরকার সাহায্যে সুতা তৈরির প্রতি মনোনিবেশ করতে হবে। এ জন্য উন্নত মানের তুলা সরবরাহের মাধ্যমে তাঁদের দিয়ে পুনরায় উন্নত মানের সুতা দিয়ে নিখাদ খাদিপণ্য তৈরি করতে হলে তাঁদের ব্যাপক আকারে প্রশিক্ষণ দিতে হবে। এ বিষয়ে বাংলাদেশ তুলা উন্নয়ন বোর্ড, বাংলাদেশ তাঁত বোর্ড, বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনসহ অন্যান্য সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে প্রয়োজনীয় সহায়তা গ্রহণ করা যেতে পারে। এসব উদ্যোগের ঘাটতির ফলে হাতে বোনা খাদি কাপড়ের বিশেষ কদর থাকলেও তাদের জন্য পৃথক ধরনের গ্রাহক ও বাজারব্যবস্থা না থাকায় হস্তনির্ভর খাদিশিল্পের অস্তিত্ব আজ হুমকির মুখে। অথচ আজও খাদি কাপড় বলতে হাতে কাটা সুতা ও হাতে বোনা খাদি কাপড়কে বোঝানো হয়, এখনো দেশীয় বাজারে কুমিল্লার আদি খাদির বিপুল চাহিদা রয়েছে। এমনকি বিশ্বব্যাপীও হাতে বোনা খাদি কাপড় ব্যাপকভাবে সমাদৃত। তবে প্রয়োজনীয় কাঁচামাল, হাতে বোনা সুতার জোগান এবং বিপণন ব্যবস্থাপনার অপ্রতুলতার কারণে খাদিশিল্পীরা ঐতিহ্যবাহী এই শিল্পের প্রসারে ভূমিকা রাখতে পারছেন না। হাতে বোনা সুতার জোগানের অভাবে মেশিনের তৈরি সুতা দিয়ে মিলের কাপড়ের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে আপ্রাণ চেষ্টা করছেন খাদিশিল্পীরা। বর্তমানে কুমিল্লার চান্দিনা, দেবীদ্বার ও হোমনায় ৫৬ থেকে ৬০টি ঘরে খাদির তাঁত আছে। কুমিল্লা শহর ও আশপাশের এলাকায় ১২০টি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানসহ সারা দেশে আনুমানিক ৫০০টি প্রতিষ্ঠান খাদি বস্ত্র বিক্রি করছে।

ব্যক্তিগত উদ্যোগে কিছু ব্যবসায়ী আধুনিক ফ্যাশনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে খাদিপণ্যের ডিজাইনে বৈচিত্র্য আনার চেষ্টা করছেন। তবে এ শিল্পের গতিশীলতা নিশ্চিত করতে সরকারের পক্ষ থেকে কোনো সুস্পষ্ট পরিকল্পনা নেই। সরকার ঋণের বিশেষ সুবিধা কিংবা তুলা আমদানির ক্ষেত্রে সহায়তাও দিচ্ছে না। ফলে ঐতিহ্যবাহী খাদিশিল্প বর্তমানে সংকটের মুখে।

খাদিপণ্যের প্রসারে প্রয়োজন দক্ষ কারিগরের। এ জন্য গড়ে ওঠেনি কোনো সরকারি প্রশিক্ষণকেন্দ্র। রপ্তানিসুবিধা, বাজার তৈরি, প্রচার ও মূল্য নির্ধারণে সরকারের উদ্যোগ চোখে পড়ার মতো নয়। বাংলাদেশের তুলনায় পাশের দেশ ভারত, শ্রীলঙ্কা, চীন ও মিয়ানমারে খাদি ও অন্যান্য বস্ত্রশিল্পে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় উন্নয়ন বেশ তরান্বিত হয়েছে বলে অভিমত ব্যক্ত করেছেন বার্ডের পরিচালক শেখ মাসুদুর রহমান।

সম্ভাবনা

শেখ মাসুদুর রহমান মনে করেন, শত প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও কুমিল্লার খাদির রয়েছে বিশাল সম্ভাবনা। বর্তমানে জেনুজি প্রজন্মের ফ্যাশনের প্রতি আগ্রহ এবং বৈচিত্র্যময় পোশাকরুচি খাদিশিল্পের জন্য নতুন দিগন্ত খুলে দিয়েছে। ঢাকার ফ্যাশন হাউসগুলো চাহিদার ভিত্তিতে আধুনিক নকশার আরামদায়ক খাদি পোশাক আনছে বাজারে। এ ধরনের পণ্যের ক্রেতাদের মধ্যে খাদির চাহিদা আরও বাড়ানো গেলে একে টিকিয়ে রাখা সম্ভব।

প্রবীণ খাদি ব্যবসায়ী প্রদীপ কুমার রাহা বলেন, পয়লা বৈশাখে খাদিপণ্যের বিক্রি বাড়ছে। এই ধারা অব্যাহত থাকলে অচিরেই ঈদ বা পূজার বিক্রিকে ছাড়িয়ে যেতে পারবে।

তবে সংশ্লিষ্ট অনেকেরই অভিমত, সম্ভাবনার কারণেই এই শিল্প এখনো টিকে আছে। তবে সরকারি সহায়তা প্রয়োজন। পাশাপাশি বৈচিত্র্যময় ডিজাইন, সৎ নেতৃত্ব এবং সরকারি পৃষ্ঠপোষকতাই কুমিল্লার খদ্দরের হারানো গৌরব ফিরিয়ে আনতে পারবে।

শেখ মাসুদুর রহমান মনে করেন, খাদিপণ্যের উন্নয়ন ও বিপণনব্যবস্থা জোরদার করা জরুরি। শুধু খাদিপণ্য নিয়ে দেশ-বিদেশে প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করা যেতে পারে। সরকারি অফিস, সেনাবাহিনী, ক্যাডেট কলেজ, হাসপাতাল, রেলওয়ে ইত্যাদিতে খাদি কাপড়ে তৈরি চাদর, পর্দা ব্যবহার করার পরামর্শ দেওয়া যেতে পারে।

খাদি একটি পরিবেশবান্ধব, স্বাস্থ্যসম্মত ও টেকসই পণ্য। এর কোনো ক্ষতিকর দিক নেই বললেই চলে। খাদির এই গুণাগুণ দেশে-বিদেশে প্রচারের ব্যবস্থা করার পাশাপাশি, খাদির মানোন্নয়ন, বাজারজাতকরণ ও প্রসার—সবই সম্ভব। এ

ক্ষেত্রে বিদেশে অবস্থিত বাংলাদেশের দূতাবাসগুলো খাদির প্রচারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে বলে মনে করেন তিনি।

জিআই সনদ ও ভবিষৎ পরিকল্পনা

প্রতিষ্ঠানিক অবকাঠামোর উন্নয়ন, যোগ্য নেতৃত্ব, বাস্তবসম্মত পরিকল্পনা ও সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার সমন্বয়ে কুমিল্লার খাদিকে টিকিয়ে রেখে একে বিশ্ব ফ্যাশনেও অন্তর্ভুক্ত করা সম্ভব। আর এই সম্ভাবনাকে মাথায় রেখে বার্ড গত বছর প্রায়োগিক গবেষণা প্রকল্প হাতে নিয়েছে বলে জানান ড. শেখ মাসুদুর রহমান। তিনি বলেন, এখানকার যুগী সম্প্রদায়ে মানুষই বহু বছর ধরে খাদি বুনে আসছেন। তবে খাদিশিল্পের সংকটের কারণে তাঁদের অনেকেই পেশা বদল করেছেন। এখনো যাঁরা আছেন, তাঁদের সংগঠিত করার মধ্যে দিয়েই বার্ড নতুন প্রকল্প শুরু করেছে। ঐতিহ্যগতভাবে কুমিল্লা অঞ্চলের মাটি, জলবায়ু, সুতা কাটা নারী শ্রমিকের সহজলভ্যতা ও বয়নশিল্পীদের দক্ষতার কারণে এখানকার হাতে বোনা খাদির ঘনত্ব, কোমলতা ও শীতলতা একে স্বতন্ত্র করে তোলে। দেরিতে হলেও এসব কারণেই মূলত কুমিল্লার হাতে বোনা খাদি ভৌগোলিক নির্দেশক বা জিআই ট্যাগ পায়, যা আন্তর্জাতিক বাজারে এর মূল্যবৃদ্ধি ও ব্র্যান্ড ভ্যালু তৈরিতে সহায়ক হবে। এ ছাড়া হাতে বোনা খাদিশিল্পী এবং এর সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত নারী শ্রমিকদের কর্মসংস্থান বৃদ্ধিসহ শিল্পটির পুনর্জাগরণে ব্যাপক ভূমিকা রাখতে পারে এই স্বীকৃতি।

উপরন্তু, হাতে বোনা খাদিকে কেন্দ্র করে খাদিপল্লি গড়ে তোলা হলে পর্যটনশিল্পেরও বিকাশ ঘটতে পারে কুমিল্লা অঞ্চলে। তাই জিআই পণ্য হিসেবে কুমিল্লা অঞ্চলের খাদিশিল্প যথাযথ পৃষ্ঠপোষকতা পেলে এটি আমদানিনির্ভর অর্থনীতি থেকে স্বনির্ভর অর্থনীতিতে প্রবেশ করার ক্ষেত্রে যথেষ্ট অবদান রাখতে পারে। এর ফলে একদিকে যেমন লুপ্তপ্রায় ঐতিহ্যবাহী খাদিপণ্যে বৈচিত্র্য ফিরে আসবে, ঠিক তেমনি তরুণ প্রজন্মকেও উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে তুলতে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে। সবচেয়ে ভালো লাগে এই ভেবে যে কুমিল্লার খাদির জিআই গৌরব অর্জনেও রয়েছে বার্ডের ঐতিহাসিক যোগসূত্র; তবে এই প্রক্রিয়ার বাস্তবায়নে কুমিল্লা জেলা প্রশাসনের ভূমিকাকে সাধুবাদ জানিয়েছেন শেখ মাসুদুর রহমান।

Screenshot_5

বার্ডের সময়োপযোগী উদ্যোগ

বার্ডের নতুন প্রকল্প সম্পর্কে বিস্তারিত জানিয়েছে শেখ মাসুদুর রহমান। বলেছেন, কুমিল্লার খাদির ভবিষ্যৎ বিনির্মাণে এখন কাজ করছে বাংলাদেশের পল্লী উন্নয়নের পথিকৃৎ বার্ড। এর উদ্যোগে কুমিল্লায় হস্তচালিত খাদিশিল্পের টেকসই উন্নয়নে হাতে বোনা সুতা ব্যবহার এবং সংশ্লিষ্ট নারী শ্রমিকদের অর্থনৈতিক অংশগ্রহণ বাড়ানোর লক্ষ্যে একটি বিশেষ প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে। প্রকল্পটির আওতায় তুলা উন্নয়ন বোর্ড থেকে সংগৃহীত তুলা দিয়ে গ্রামীণ নারী কাটুনিরা সুতা কাটছেন। সেই সুতা স্থানীয় খাদিশিল্পীদের সরবরাহ করা হচ্ছে। এতে ঐতিহ্যবাহী খাদিপণ্যের গুণগত মান বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং একই সঙ্গে দরিদ্র নারীদের কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করাও সম্ভব হচ্ছে। শুধু তাুই নয়, সুতা তৈরির কাজে নিয়োজিত নারী শ্রমিকেরা প্রথমে ‘ওয়ার্ক বেইজড লার্নিং’ পদ্ধতিতে প্রশিক্ষণের সুযোগ পাচ্ছেন। প্রকল্পটি মূলত কুমিল্লার চান্দিনা উপজেলার সোনাপুর গ্রামের কাটুনি এবং দেবীদ্বার উপজেলার বড়কামতা গ্রামের হস্তনির্ভর বয়নশিল্পীদের মধ্যে পরিচালিত হচ্ছে।

শেখ মাসুদুর রহমান বলেন, এই প্রকল্পের ব্যবস্থাপনায় তুলা উন্নয়ন বোর্ড, নারী শ্রমিক, খাদিশিল্পী, ডিজাইনার ও মিডিয়া প্রতিনিধিদের নিয়ে কম্পোনেন্টুভিত্তিক একটি কাঠামো গড়ে তোলা হয়েছে। মাঠপর্যায়ের কাজ দেখাশোনা করছেন বার্ডের দুজন গ্রাম উন্নয়ন কর্মী এবং সার্বিক দিকনির্দেশনায় রয়েছেন বার্ডের অনুষদবৃন্দ। এ প্রকল্পেরই অংশ হিসেবে শুরুতে দুটি সংগঠন গঠন করা হয়। এতে কাজ করেন মূলত নারী কাটুনি ও বয়নশিল্পীরা। প্রতিটি দলে একজন গ্রাম উন্নয়ন কর্মী নিয়োগ দেওয়া হয়। ফ্যাশন হাউস ‘কারুভূমি’র মাধ্যমে ফিনিশিং প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়। বার্ড ৩০ শতাংশ ও কারুভূমি ৭০ শতাংশ খাদিপণ্যের বিপণনে ভূমিকা রাখছে। এই আয়ের পাশাপাশি আছে গবেষণা ব্যয়। পুরো প্রক্রিয়া খাদির গুণগত মানোয়ন্ন তরান্বিত করবে বলেই আশাবাদী শেখ মাসুদুর রহমান।

এ ছাড়া শেখ মাসুদুর রহমান মনে করেন, এই প্রকল্পের আধুনিকায়ন ঘটেছে এই একটি পদক্ষেপের মাধ্যমে। এই প্রকল্পে ফ্যাশন ডিজাইনার ও কারুশিল্পীদেরও যুক্ত করা হয়েছে, যাতে খাদিপণ্যকে আধুনিক রুচিসম্মতভাবে উপস্থাপন করে ক্রেতাদের মধ্যে এর আবেদন ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়। খাদি পোশাকে নতুন নতুন নকশা ও এর বাজারজাতকরণে তাঁরা সর্বাত্মক সহযোগিতা করছেন। পাশাপাশি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও প্রচারমাধ্যমকে সম্পৃক্ত করে প্রচারণা চালানো হচ্ছে।

বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী খাদিশিল্পকে পুনর্জাগরণ এবং গ্রামীণ অর্থনীতিকে শক্তিশালী করার ক্ষেত্রে এ প্রকল্প একটি কার্যকর ভূমিকা পালন করবে বলে আশাবাদী সবাই। আমদানিনির্ভরতা হ্রাস এবং উদ্যোক্তা তৈরিতে এটি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে পারে।

শেখ সাইফুর রহমান: গবেষক

বিষয়:

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

১

কোন সরকারই পরিবেশ সংরক্ষণে কার্যকর ভূমিকা রাখেনি

২

কুমিল্লায় পরিবেশ অধিদপ্তরের অফিস নেই

৩

লালমাই পাহাড়কে সবচেয়ে বেশি ধ্বংস করেছে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়

৪

গরুর বাজারের একাল-সেকাল

৫

জাতীয় ঐক্য ছাড়া নির্বাচন সম্ভব না

সম্পর্কিত

কোন সরকারই পরিবেশ সংরক্ষণে কার্যকর ভূমিকা রাখেনি

কোন সরকারই পরিবেশ সংরক্ষণে কার্যকর ভূমিকা রাখেনি

১২ ঘণ্টা আগে
কুমিল্লায় পরিবেশ অধিদপ্তরের অফিস নেই

কুমিল্লায় পরিবেশ অধিদপ্তরের অফিস নেই

১৩ ঘণ্টা আগে
লালমাই পাহাড়কে সবচেয়ে বেশি ধ্বংস করেছে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়

লালমাই পাহাড়কে সবচেয়ে বেশি ধ্বংস করেছে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়

১৩ ঘণ্টা আগে
গরুর বাজারের একাল-সেকাল

গরুর বাজারের একাল-সেকাল

২ দিন আগে